নিজস্ব প্রতিবেদক »
‘যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে। এসো গান করি মেঘো মল্লারে করুণা ধারার দৃষ্টিতে। আসবেনা তুমি , জানি আমি জানি।’ সকলেরই জানা ফিরবেন না তিনি। ২০১২ সালের আজকের এ দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন দেশের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
অনিবার্য পরিণতি জেনেও মৃত্যুর প্রতি তার ছিল প্রবল আগ্রহ। উপন্যাস , নাটক , গানে এমনকি ব্যক্তিজীবনেও তিনি এ নিয়ে সরগরম থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে আটক করে গুলি চালালেও বেঁচে যান তিনি। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেই হয়তো তিনি বেঁচে থাকার উদযাপনটাতে গুরুত্ব দিতেন। করতেন মায়ের মৃত্যু নিয়ে রসিকতা, নিজের এডভান্স কুলখানি নিয়ে অকাতরে হতেন রোমাঞ্চিত। কিন্তু এসব ব্ল্যাক হিউমারের আড়ালেও বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছাকে তিনি লুকিয়ে রাখতে পারেননি।
বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে জ্যোৎ¯œা থাকবে , টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টি থাকবে কেবল আমি থাকবো না, তা-ই কি হয়? মৃত্যু অনিবার্য হলেও নিউইয়র্ক থেকে যখন তাঁর মরদেহ ঢাকায় আনা হয় দেশ বিদেশের লাখো কোটি ভক্ত টেলিভিশনের পর্দায় প্রত্যক্ষ করছিলেন একটি অবিস্মরণীয় দৃশ্য। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা হাজার হাজার মানুষের সাথে শ্রাবণের ধারায় শেষযাত্রায় সিক্ত হচ্ছিলেন বৃষ্টিবিলাসী হুমায়ুন। সেইসময় হুমায়ূনের লেখা ‘তুমি চলো এসো এক বরষায় ’ পংক্তিটি পরিণত হয়েছিলো প্রার্থনায়।
দীর্ঘদিন বৃহদান্ত্রের মরণঘাতী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ডাক্তার জানিয়েছিলেন সর্বোচ্চ ২ বছর বাঁচবেন তিনি। অস্ত্রোপচার শুরর আগে নিউইয়র্কের অন্যতম সার্জন মিলার মেঝের দিকে তাকিয়ে হুমায়ূনকে জানিয়েছিলেন, যদি তিনি নিজে অস্ত্রোপচার করান তাহলে তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনা শূন্য শতাংশ। আশ্বস্ত হয়েছিলেন হুমায়ূন। অস্ত্রোপচারের পূর্বে দেখে গেলেন প্রিয় স্বদেশের প্রিয়মুখ, প্রাণের নুহাশ পল্লী।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমায় মোহনগঞ্জে মাতামহের বাড়িতে হুমায়ূন আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা পিএইডি অর্জন করেন।
মৃত্যুর ১০ বছর আগে ২০০৩ সালে বিচ্ছেদের ফলে তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খানের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যেখানে রয়েছে তাঁর নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ ও বিপাশা আহমেদ নামের তিন কন্যা এবং নুহাশ হুমায়ূন নামের এক পুত্র। ২০০৫ সালে বিয়ে করেন তাঁর বেশকিছু নাটক ও চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে। এই পরিবারে তাঁর রয়েছে নিশাদ হুমায়ূন এবং নিনিত হুমায়ূন নামে দুই পুত্র। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও তাঁর উপলব্দি থেকে জানা যায় , ‘মানুষের মন বিচিত্র জিনিস। সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জের যে জটিলতা ও রহস্য তার থেকেও রহস্যময় মানুষের মন।’
জীবদ্দশায় তিনি বেশ কয়েকটি উপন্যাস , ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ,গান লিখেছিলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। হুমায়ূন আহমেদ রচিত অন্যতম উপন্যাসগুলো হলো মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প , মাতাল হাওয়া ,লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার। তাঁর উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র মিসির আলী , হিমু, রুপা, শুভ্র। তাঁর অন্যতম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ,‘দুই দুয়ারী’ , ‘শ্যামলছায়া’ ও ঘেঁটুপুত্র কমলা’।
অন্যতম নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘বহুব্রীহী’, ‘এইসব দিনরাত্রি’ ,‘ আজ রবিবার’, ‘সবুজ সাথী’ ,‘ নক্ষত্রের রাত’ ইত্যাদি। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯২, ১৯৯৪ ও ২০০৭ সালে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
ভক্তদের অকুন্ঠ ভালোবাসা পাওয়া হুমায়ূন প্রকৃতিকে উদযাপন করতেন , জীবনের গুরুতর বিষয় নিয়েও করতেন ঠাট্টা রসিকতা। তাঁর নাটকে প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের গান যেভাবে স্থান পেতো তাতে বলা চলে তিনি রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন। তাই রবি ঠাকুরের মতো তিনিও হয়তো বিশ্বাস করতেন ‘ জীবনটাকে কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার চাইতে হেসে উড়িয়ে দেওয়াই ভালো।’


















































