ভূঁইয়া নজরুল »
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর। সাগর থেকে জেগে উঠা প্রায় ৩০ হাজার একর ভূমিতে গড়ে উঠতে যাচ্ছে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল। আগামী ১০ বছরে ১২০ প্রতিষ্ঠানের এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করা হয়েছে মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও সোনাগাজীর এলাকায় গড়ে উঠতে যাওয়া এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে। কিন্তু পানি ছাড়া উন্নয়নের সব পরিকল্পনাই অচল।
চট্টগ্রামের হালদা নদী থেকে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হলেও পরিবেশবাদীদের চাপের মুখে সেখান থেকে সরে আসে। এখন প্রাথমিকভাবে ফেনী নদী ও মুহুরী নদীর পানি পরিশোধন করে দৈনিক পাঁচ কোটি লিটার পানি সরবরাহের প্রকল্প নেওয়া হলেও তা অপ্রতুল। বর্তমানে প্রতিদিন ১০৩ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে। তাহলে এই পানি কোথা থেকে আসবে?
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর বাস্তবায়নের কাজ করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। পানির সমস্যার বিষয়ে কথা হয় সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক ( প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) দয়ানন্দ দেবনাথের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা ভূ-গর্ভস্থ পানি এবং ফেনী ও মুহুরী নদী থেকে পানি নিয়ে কাজ চালাচ্ছি। কিন্তু এগুলোতে সমাধান নেই। পানির স্থায়ী সরবরাহ প্রয়োজন। এজন্য হালদায় একটি প্রকল্প নেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল কিন্তু তা এখন আর হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমাদের দিনে ১০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন। আগামী পাঁচ বছরে যদি ২০ শতাংশ কারখানাও গড়ে উঠে তাহলে দিনে ২০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হবে। পুরো প্রকল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে টার্গেট ধরা হয়েছে ২০৪০ সাল। তখন দিনে প্রায় ১০০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হতে পারে। আর পানির চাহিদা নির্ভর করছে কোন ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে সেগুলোর উপর।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন মেঘনা থেকে পানি আনার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু মেঘনা থেকে পানি আনা হলে এর খরচ বেড়ে যেতে পারে। এতে কারখানার উৎপাদন খরচও বাড়বে। সব বিষয়ে বিবেচনা করে কালকের (আজ বুধবার) সভায় একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোয়াজ্জল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে আজ বুধবার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে প্রয়োজনীয় পানির সম্ভাব্য উৎস শনাক্তকরণের লক্ষ্যে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভাকক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় বেজা, স্থানীয় সরকার বিভাগ, বেপজা, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম ওয়াসা, আইডব্লিউএম এর প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
পানির উৎস কোথায়?
এদিকে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে কোথা থেকে পানি নেয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে সরকারের পানিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা ভূ-গর্ভস্থ পানি, সাগরের লবণাক্ত পানি, ফেনী ও মুহুরী নদীর পানি, হালদা-কর্ণফুলী ও কাপ্তাই হ্রদের পানি এবং সর্বশেষ মেঘনা নদী থেকে পানি নিয়ে কাজ করছি। এসবের মধ্যে হালদা নদীর বিষয়টি পরিবেশগত কারণে বিবেচনা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এসব উৎসের মধ্যে কোনটি বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরের পানি সমস্যা সমাধান করতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘লবণাক্ত পানি পরিশোধন করে ব্যবহার করা ব্যয়সাপেক্ষ। তাই তা লাভজনক হবে না। ফেনী ও মুহুরী নদী থেকে বেশি পরিমাণে পানি পাওয়া যাবে না। একই অবস্থা কাপ্তাই হ্রদ থেকেও। তাই আমরা মেঘনা নদী থেকে পানি আনা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য যুঁতসই মনে করছি।’
সমাধান মেঘনার পানিতে
মেঘনা নদী থেকে চাহিদামতো পানি পরিশোধন করা যাবে জানিয়ে আইডব্লিউএমের নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খান বলেন, ‘মিরসরাইয়ের আশেপাশে যেসব উৎস রয়েছে সেগুলো একটা সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে কিংবা পানির উৎস কমে যেতে পারে। কিন্তু মিরসরাইয়ে বেশি পরিমাণে পানির প্রয়োজন হবে বলে মেঘনা থেকে পানি সংগ্রহ করাই উত্তম হবে। এতে যতো প্রয়োজন হবে, ততোই পরিশোধন করে সরবরাহ করা যাবে।’
তিনি আরো বলেন, একইসাথে পানির একটি গ্রিড লাইন পাওয়া যাবে। সেই গ্রিড লাইন থেকে জেলা ও উপজেলা সদরগুলোতেও ভবিষ্যতে সুপেয় পানি সরবরাহ করা যাবে।
এদিকে পানির পরিশোধন নিয়ে কাজ করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চাঁদপুর রেলস্টেশনের কাছে যে পয়েন্ট থেকে পানি সংগ্রহ করা হবে সেই স্থানে ডাকাতিয়া, পদ্মা ও মেঘনা মিলিত হয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির বিশাল সংগ্রহ রয়েছে সেখানে। সেই পয়েন্ট থেকে মিরসরাইয়ে পানি আনতে ১৩৩ কিলোমিটার পাইপ লাইন বসাতে হবে।’
দীর্ঘ পাইপ লাইন বসালেও এটার স্থায়িত্ব বেশি হবে জানিয়ে প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে পানির সমস্যা হবে না। প্রাথমিকভাবে সেখান থেকে ৫০ কোটি লিটার পানি নেয়া যেতে পারে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা যাবে সেখান থেকে।’
পানি পাবে চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনী জেলা সদরেও
মেঘনা থেকে পানি আনা হলে চার জেলা সদরের পাশাপাশি উপজেলা সদরগুলোও পানি পাবে উল্লেখ করে প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চাঁদপুর থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি আনার পথে জেলা ও উপজেলা সদরগুলোতে আমরা পানি সরবরাহ করতে পারবো। এতে জেলাসদরে সুপেয় পানি নিশ্চিত হবে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমবে।’
এ বিষয়ে আইডব্লিউএমের নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খান বলেন, জেলা ও উপজেলা সদরে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে পারলে জাতিসংঘের এসডিজি ডেভেলপমেন্টেও আমাদের সূচক বাড়বে। এছাড়া এই পাইপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নতুন নতুন এলাকায় পানি সরবরাহ করা যাবে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও সোনাগাজীর চরাঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার একর ভূমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর।
ইতোমধ্যে সেখানে কিছু শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে এবং বাকি এলাকায় কারখানা স্থাপনের কাজ চলছে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে প্রায় ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এই শিল্পনগরে।
আশা দেখাচ্ছে মেঘনার পানি
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আজকের সভায় নির্দেশনা আসতে পারে, সুপেয় পানি যাবে চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনী উপজেলা সদরে