হাফিজ রশিদ খান :
‘মানব’ শব্দটা বহুমাত্রিক। এ হাত ধরেই আসে মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিল্পকলা, গান-কবিতা তথা উৎকৃষ্ট আচরণকলা। অতি নিকট থেকে কম দেখা হওয়া সত্ত্বেও চিঠিপত্র লেখা, হালের মোবাইলফোনে কথাবার্তা বিনিময়ের সুবাদে এই মানবটার একটা পরিচ্ছন্ন আদল আমার ভেতরে খাড়া হয়ে আছে। তাঁকে চাক্ষুষ করারও আগে তাঁর কাজের পরিধি বিষয়ে কিছু জানতাম। তিনি (মফিদুল হকসহ) বিগত শতকের আশি’র দশকের প্রথম দিকে ‘হৃদয়ে আমার প্যালেস্টাইন’ (১৯৮২), ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ (১৯৮৩), ‘গণসাহিত্য’ পত্রিকা ও দীর্ঘদিন ‘সংবাদ’-এর সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করেছেন। চারুশিল্পীদের সৃজনশীল কাজ ও রঙের বিচিত্র ভুবনের অপূর্ব ছবি আঁকতেন কলমের ডগায়। আর কবিতাচর্চা করতেন মাহমুদ আল জামান ছদ্মনামে। ঢাকার মনস্বীজনেদের সঙ্গে কখন্-োসখনো কিছু বলতেন আলোচনা সভায়, সেমিনারে। এসবও পেতাম খবর কাগজের সাহিত্য-শিল্পের পাতায়।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে বেশ দুঃসাহসে ভর করে ‘সংবাদ’-এর ৩৬ বংশাল রোড-ঢাকার ঠিকানায় তাঁর কাছে কবিতা পাঠাতাম সরকারি ডাকে। একটা সুন্দর মনভোলানো চিঠিও থাকতো তাতে, যেন পাঠানো কবিতা তাঁর বিবেচনার আওতায় থাকে। মাঝে-মধ্যে ছাপাও হয়ে যেতো সেই থরোথরো প্রগল্ভতা। ফলে নিভৃতে নিজের ভেতর জেগে উঠেছিল নির্মল অহমিকার একটা ঘোরও, যার নামÑ আত্মবিশ্বাস। এই গোপনভার বয়ে-বয়ে বহুদিন পার হয়ে গেল।
১৯৯৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আদিবাসী কাব্য’ নামে একটি কবিতাপুস্তিকা প্রকাশ করে কিছু কপি নিয়ে বাংলা একাডেমির একুশের গ্রন্থমেলায় যাই। অযাচিত আতিথ্য গ্রহণ করি গল্পকার ও ‘ভোরের কাগজ’-এর সেই সময়কার তরুণ সাংবাদিক রাজীব নূরের ডেরায়। রাজীব ওই কবিতাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েছে, তার ভাবান্তর লক্ষ করা গেল। তার অতো ব্যস্ততার মাঝেও কি মনে করে যেন সে আমাকে দুজন মানুষের কাছে নিয়ে গেল। একজন আবুল হাসনাত, দ্বিতীয়জন হুমায়ুন আজাদ। বংশাল রোডের এক আলো-আঁধারি ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠেছিলাম ওর পিছু-পিছু। যে-কক্ষে হাসনাত ভাই বসেন ওখানে তাঁর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রাজীব আমার বিষয়ে একটা ফিরিস্তি দিল। তিনি নীরবে শুনে গেলেন। বসতে বললেন না। অবশ্য কক্ষটাতে চেয়ারের ব্যবস্থাও ছিল না। আমি তাঁর নাম লিখে পুস্তিকাটা হাতে দিলে বেশ কিছুক্ষণ ওল্টেপাল্টে দেখলেন। আমার দিকেও খানিকটা তাকালেন। তবে কিছু বললেন না। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাজীব ‘চলেন হাফিজ ভাই’ বললে আমিও ওর পিছে-পিছে নেমে আসি রাস্তায়। তারপর প্রতি বৃহস্পতিবার ‘সংবাদ’-এর সাহিত্যপাতা দেখি। না, কোনো আলোচনা বা প্রাপ্তিসংবাদ পাই না দীর্ঘদিন। নাকি আমারই চোখ এড়িয়ে গেল!
শূন্যদশকে বেশ পরিবর্তন এসে গেল বাংলাদেশের প্রকাশনাজগতে। ঢাকা থেকে ‘কালি ও কলম’ নামে সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা বেরোতে থাকলে বেশ আনন্দ পেলাম। কাগজটির সম্পাদক আবুল হাসনাত বলেই কি! ‘কালি ও কলম’-এর অঙ্গসৌষ্ঠব ও ছাপা ভারি পরিপাটি। মেধা ও শ্রমের যুগলবন্দি যেন। আগ্রহ নিয়ে কিনি, পড়ি।
মাসটা মনে পড়ছে না, ২০১০ সালের দিকে ‘কালি ও কলম’ চট্টগ্রামে একটি কবিতাসন্ধ্যার আয়োজন করে থিয়েটার ইনস্টিটিউট-চিটাগাং মিলনায়তনে। ‘বাতিঘর’-এর দীপংকর দাশ ছিল অনুষ্ঠানটির যোগসূত্র। সে আমাকে ফোনে জানালো বিষয়টা। পরে হাসনাত ভাইও ফোন করলে একটু অবাক হই। বলেন, দুটো কবিতা পড়বেন। সংবাদপত্রের সান্ধ্যাকালীন চাকরির কথা জানিয়ে একটু
দেরি হতে পারে জানালে তিনি বলেন, ‘আসুন, আসুন’। ওই অনুষ্ঠানে কবিতাপাঠ শেষে নিজহাতে ‘কালি ও কলম’-এর একটি সুন্দর ডায়েরিসহ সম্মানী তুলে দেন। এবং বলেন, রাতের ভোজ উৎসবে যেন উপস্থিত হই।
কিন্তু কর্মস্থল থেকে বেরোতে রাত বেড়ে যাওয়ায় ওই ভোজে আমার অংশ নেওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম ঘটনাটার ইতি এখানেই। পরদিন সকাল ১০-১১টার দিকে হাসনাত ভাইয়ের ফোনকল পেয়ে একটু চমকে উঠি, কাল ডিনারে আসলেন না যে! আমার মুখ থেকে ওপরের ঘটনাটা শুনে অনেকটা অভিভাবকের মতোই এবার বললেন, ‘কালি ও কলম’ এ কবিতা পাঠাবেন।’
তাঁর সংগতিপূর্ণ, মার্জিত ও ভারসাম্যমূলক এসব আচরণ আমাকে তাঁর সবিশেষ অনুরাগী করে তোলে অজান্তে। তাই মাঝেমধ্যে দূরত্বের মর্যাদা বজায় রেখে মোবাইলে খোঁজখবর নিতাম। সর্বশেষ গত ১ অকটোবর ২০২০ দুপুর ১২টার দিকে তাঁকে ফোনকল দিলে তিনি আগের মতোই প্রাণিতস্বরে কথা বললেন। জানালেন, করোনাকালে ঘরেই অফিস চলছে। ভালোই আছেন। আর ১ নভেম্বর সকালের দিকে ফেসবুক-এর একটি স্থিতি থেকে প্রথম জানলাম, তিনি ৭৫ বছর বয়সে হৃদরাগে আক্রান্ত হয়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন।
লেখালেখির সূত্রেই তাঁর সঙ্গে সামান্য জানাশোনা। এ পথে তাঁকে যতটুকু জেনেছি, মনে হয়, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির একটা বড় গথিক স্তম্ভই খসে গেল। আমরা যারা ঢাকা শহরের বাইরে কিছুটা লেখালেখির চেষ্টা করি, তারা কি আরেকজন আবুল হাসনাতের দেখা পাবো, যিনি নম্র অথচ সাহস সঞ্চারী কণ্ঠে বলবেন, ‘কবিতা পাঠাবেন!’