বন্ধুত্বের ছায়া

এম আব্দুল হালীম বাচ্চু »

অনেকদিন আগের কথা, লক্ষ্মীপুর গ্রামে গহিন এক জঙ্গল ছিল। এখানে মানুষের সংখ্যা খুব কম ছিল যেকারণে প্রকৃতির আশীর্বাদে বড়ো বড়ো গাছপালার সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তা দেখে জঙ্গল মনে হতো।দিনের বেলাতেও মানুষ একা চলাফেরা করতেও ভয় পেত। ঘন জঙ্গল বললেও ভুল হবে না! মাঝে মাঝে চিতাবাঘ, শেয়াল বেজি সাপসহ বিভিন্ন রকমের জীবজন্তু দেখা যেত। এই গ্রামের পাশেই রয়েছে ডেমরা গ্রাম। যা এখন আধুনিক একটি গ্রাম। এই ডেমরাতেই ছিল পুরাতন একটি গোডাউন; আর এই গোডাউনেই থাকত একটি ইঁদুর, নাম তার মিন্টু। সে ছিল খুবই চালাক আর কৌতূহলী। মিন্টু দিনে ঘুমাত আর রাতে গোডাউনের নানা জিনিসে ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজত।
গোডাউনের মালিক নতুন করে একটি বিড়াল নিয়ে এলো- নাম তার ঝিলিক। ঝিলিক ছিল শহর থেকে আসা, নরম তুলোর মতো লোম আর চোখে সব সময় একটা রহস্যময় দীপ্তি। মালিক বলল, “এই বিড়াল তোমাদের সব ইঁদুর তাড়িয়ে দেবে!” মিন্টু তা শুনে ভয় পেল বটে, তবে সে সহজে হাল ছাড়ল না।
রাতের বেলা ঝিলিক যখন ঘোরাফেরা করত, মিন্টু লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে লক্ষ করত। কিছুদিন পর সে খেয়াল করল, ঝিলিক কাউকে ধরছে না, শুধু চুপচাপ বসে থাকে জানালার পাশে। মিন্টু সাহস করে এক রাতে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি আমাকে ধরছ না কেন?”
ঝিলিক হেসে বলল, “আমি শহুরে বিড়াল। ইঁদুর ধরা আমার কাজ না। আমি আসলে এখানে শান্তি খুঁজতে এসেছি।” মিন্টু অবাক হলো, “তুমি শান্তি চাও? আমাদের গ্রামের ইঁদুর আর বিড়াল তো চিরশত্রু!”
“তাই তো,” ঝিলিক বলল। “তবে সব সম্পর্ক যে, চিরশত্রুতায় চিরকাল আবদ্ধ থাকবে এমন কোনো কথা নেই।”
এরপর থেকে তারা রাতে আড্ডা দিতে শুরু করল। মিন্টু তাকে পুরাতন বইয়ের পেছনে লুকোনো পনিরের টুকরো দেখাত, আর ঝিলিক তাকে জানালার ওপাশের চাঁদের আলো দেখাত। একদিন মিন্টু বলল, “তুমি শহরের গল্প বলো তো, কেমন ছিল তোমার শহরের পরিবেশ?” ঝিলিক বলল, ‘শহরে আলো আছে, কিন্তু সময় নেই। এখানে সময় আছে, আলো কম, কিন্তু শান্তি আছে।”
একদিন গোডাউনের মালিক একদম রেগে গিয়ে বলল, “এই বিড়াল কিছুই করছে না! এবার অন্য বিড়াল আনব।” মিন্টু ভয় পেল- নতুন বিড়াল মানেই মৃত্যু। সে ঝিলিককে বলল, “তুমি পালাও, নয়তো তোমার বদলে ভয়ংকর কেউ আসবে।”
কিন্তু ঝিলিক বলল, “না, পালিয়ে গেলে তো আবার ভয় জয় করবে। আমি কিছু একটা করবই।”
রাতে ঝিলিক কিছু বন্ধু বিড়ালদের খবর পাঠাল শহরে। তারা এল পরদিন। মিন্টুর বন্ধুরা আশেপাশে ছড়িয়ে গেল। ঝিলিকের পরিকল্পনায় তারা সবাই মিলে এক অভিনয় করল- একটি ‘ইঁদুর ধরার নাটক’। কিছু পুরানো কাপড় আর চালের বস্তা ফেলে এমনভাবে সাজাল যেন ঝিলিক সত্যিই ইঁদুর ধরেছে।
মালিক খুশি হয়ে বলল, “এই তো, আমার ঝিলিক কত কাজের!”
এরপর আর কোনো নতুন বিড়াল এলো না। ঝিলিক আর মিন্টু ছায়ার মতো একে অপরের বন্ধু হয়েই রইল।
শত্রুতা যেখানে প্রথা, সেখানে বন্ধুত্ব এক মহাবিপ্লব। মিন্টু আর ঝিলিক সেই মহাবিপ্লবই ঘটিয়েছিল সেদিন, একদম ঠাণ্ডা মাথায়।