হানিফ রাজা »
ময়মনসিংহ জেলার এক ছোট গ্রাম চরগাঁও। গ্রামের চারদিকে ধানক্ষেত, পুকুর, আর কাঁচা রাস্তা। সে গ্রামেরই এক গরিব ঘরে জন্ম নেয় ছোট্ট মেয়ে তানিয়া। বয়স এখন বারো। বাবা একজন কাঠমিস্ত্রি, মা গৃহিণী। সংসারে টানাপোড়েন লেগেই থাকে, তবু হাসিখুশি পরিবার।
তানিয়া ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি ভালোবাসে। মাঠের ঘাসে বসে প্রজাপতি ধরতে ভালো লাগে তার। গাছের ফুল তুলে চুলে গুঁজে রাখে, আবার ফুল শুকিয়ে বইয়ের পাতায় রেখে দেয়। তার কাছে ফুল মানেই আনন্দ, জীবনের হাসি।
একদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় তানিয়া দেখল, ঝড়-বৃষ্টিতে গ্রামের সব ফুল ঝরে পড়েছে। গাছে একটিও ফুল নেই। মাঠভর্তি কাদা, আর বাতাসে ভেসে আসে পচা পাপড়ির গন্ধ। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার।
স্কুলে পৌঁছে সে দেখে, তার সহপাঠী মিতা, রিয়া আর পলাশ সবাই ফুল ছাড়া এসেছে। সাধারণত সবাই চুলে, ব্যাগে বা কলমে একটা করে ফুল রাখে। শিক্ষকও প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে এসে বলেন,
“ফুল যেমন সৌন্দর্যের প্রতীক, তেমনি তোমরা মানুষ হিসেবে ভালোবাসা আর সততার ফুল ফোটাবে।”
কিন্তু সেদিন শ্রেণিকক্ষটাও যেন নিরানন্দ। তানিয়া কোণে বসে ভাবতে লাগল, “ফুল তো শুধু গাছে ফোটে না, মানুষও বানাতে পারে।”
বিকেলে স্কুল ছুটির পর সে বাবার কারখানায় চলে গেল। কাঠের গুঁড়ি, করাত, ছেঁড়া করাতের ধুলো সব জায়গায় একধরনের গন্ধ।বাবা বললেন,
“কি রে তানিয়া, আবার কিছু বানাবি নাকি?”
তানিয়া মুচকি হেসে বলল,
“বাবা, তুমি তো কাঠ দিয়ে চেয়ার, টেবিল, খাট বানাও। আমি যদি কাঠ দিয়ে ফুল বানাই?”
বাবা হেসে মাথা নাড়লেন,
“কাঠের ফুল? বানাতে পারলে দেখ, আমি রং এনে দেব।”
তানিয়া একটা ছোট কাঠের টুকরো নিল। রাতে পড়া শেষ করে সে বসে পড়ল সেই কাঠ ঘষে ঘষে কেটে নিতে। প্রথমে কাঠ ভেঙে গেল, হাতে কেটে রক্ত বের হলো। মা এসে বললেন,
“এই কাজগুলো বড়দের। তুই ঘুমা।”
কিন্তু তানিয়া বলল,
“মা, আমি ফুল ফোটাবো, কাঠের ফুল।”
দুই দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে ছোট্ট একটা কাঠের গোল পাপড়ি বানাতে পারল। তারপর সে পুরনো রঙপেন্সিল দিয়ে পাপড়িগুলো রাঙাল লাল, নীল, হলুদ। এক টুকরো তার দিয়ে বানাল ডাঁটা। সবশেষে একটা পুরনো বোতলের মুখে সেটি বসিয়ে রাখল।
তৃতীয় দিন সকালে সে সেই ফুল ব্যাগে রাখল। স্কুলে গিয়ে চুপচাপ বেঞ্চে বসে পড়ল। শিক্ষক এলেন, সবাই উঠে দাঁড়াল। তানিয়া ব্যাগ থেকে ফুলটা বের করে টেবিলের ওপর রাখল।
শিক্ষক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা কোথায় পেলি?”
তানিয়া মৃদু হেসে বলল,
“স্যার, ঝড়ের পর সব ফুল ঝরে গিয়েছিল। তাই আমি কাঠের ফুল বানিয়েছি।”
সবার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। মিতা বলল,
“তুই নিজে বানিয়েছিস?”
তানিয়া মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, এটা আমার মনের ফুল।”
শিক্ষক ফুলটা হাতে নিয়ে গভীরভাবে দেখলেন। কাঠের ফুল হলেও তার রঙে, গঠনে, আর পরিশ্রমে ছিল এক ধরনের প্রাণ। তিনি মুগ্ধ হয়ে বললেন,
“তানিয়া, আজ তুমি আমাদের সবাইকে একটা বড় শিক্ষা দিলে। ফুল কেবল গাছে ফোটে না, মানুষের মনেও ফোটে যদি পরিশ্রম আর ভালোবাসা থাকে।”
সেদিনের পর থেকে তানিয়া গ্রামের সবাইকে অবাক করে দিল। সে বিভিন্ন কাঠের টুকরো দিয়ে ফুল, পাখি, মাছ বানাতে লাগল। গ্রামের মেলা হলে সেখানে তার ছোট্ট স্টল বসে। মানুষ এসে বলে,
“এই যে ফুলটা কাঠের, তবু দেখতে জীবন্ত!”
একদিন উপজেলা কর্মকর্তা এসে তার কাজ দেখে বললেন,
“তুমি যদি চাও, আমরা তোমার শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে রাখব।”
তানিয়া লজ্জায় হাসল।
বছর শেষে সে স্কুলে প্রথম হলো। পুরস্কার হিসেবে পেল রঙতুলি আর কাঠের কাজের সরঞ্জাম। শিক্ষক বললেন,
“এই মেয়ে একদিন বড় শিল্পী হবে। যার হাতে কাঠও ফুল হয়ে ওঠে, সে কিছুই অসম্ভব করে না।”
তানিয়া তখনো সেই কাঠের ফুলটা ধরে আছে যেটা থেকে শুরু হয়েছিল তার স্বপ্নের গল্প।
সেদিন থেকে গ্রামের সবাই তাকে ভালোবেসে ডাকতে লাগল ‘ফুলতানিয়া’ নামে।
আর তানিয়া বিশ্বাস করে,
“সৌন্দর্য শুধু প্রকৃতির দান নয়, পরিশ্রম, ধৈর্য ও সৃজনশীলতা থাকলে জীবনের প্রতিটি কাঠিন্যও হয়ে ওঠে সৌন্দর্যময় ফুলের মতো।’




















































