চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল
অগ্রাধিকার পাবে বাল্ক ও গিয়ারড জাহাজ
২০০৭ এর পর প্রথমবারের মতো নতুন জেটিতে ভিড়বে জাহাজ
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হতে পারে সেপ্টেম্বরে
ভূঁইয়া নজরুল»
অবশেষে ২১ জুলাই পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (পিসিটি) জেটিতে ভিড়তে যাচ্ছে জাহাজ। পরীক্ষামূলকভাবে বাল্ক জাহাজ (খোলা পণ্যবাহী জাহাজ) ভিড়লেও পর্যায়ক্রমে গিয়ারড জাহাজ (নিজস্ব ক্রেনযুক্ত জাহাজ) অগ্রাধিকার পাবে পিসিটিতে। আর এই জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর মধ্য দিয়ে ২০০৭ সালের পর নতুন কোনো জেটিতে প্রথম জাহাজ ভিড়তে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে জিসিবি (জেনারেল কার্গো বার্থ), সিসিটি ( চিটাগাং কনটেইনারা টার্মিনাল) ও এনসিটির ( নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল) পর যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (পিসিটি)।
গতকাল দুপুরে পিসিটি এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, টার্মিনালে প্রবেশ মুখে (গেইট) একাধিক শ্রমিক কাজ করলেও ইয়ার্ডের ভেতরে কাজ প্রায় সমাপ্ত। জেটি প্রস্তুত হয়ে আছে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য। তবে জেটি প্রস্তুত থাকলেও ইয়ার্ড এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। কিন্তু তারপরও আগামী ২১ জুলাই জাহাজ ভেড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে কাস্টমস কর্তৃপক্ষসহ চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন দপ্তরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে প্রস্তুত থাকার জন্য। গতকাল সকালে পিসিটি ইয়ার্ড এলাকা পরিদর্শন করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান।
পিসিটি চালু প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘ আমরা আগামী ২১ জুলাই পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। প্রথম দিনে বাল্ক জাহাজ ভেড়ানোর মাধ্যয়ে ইয়ার্ডের কার্যক্রম চালু করা হবে। পরবর্তীতে কনটেইনারবাহী জাহাজও ভেড়ানো হবে। তবে এক্ষেত্রে গিয়ারড জাহাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পিসিটিতে ভেড়ানোর সুযোগ পাবে।’
কিন্তু পিসিটিতে তো কোনো ইকুইপমেন্ট নেই। তাহলে কিভাবে পণ্য লোডিং ও আনলোডিং হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ইকুইপমেন্টের পাশাপাশি জাহাজের ক্রেন দিয়ে পণ্য লোডিং ও আনলোডিং করা হবে। তাই সমস্যা হবে না।’
২১ জুলাই পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন কবে হতে পারে সেবিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সেপ্টেম্বরে পিসিটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা যায়, পিসিটিতে গিয়ারড (ক্রেন রয়েছে এমন জাহাজ) জাহাজ এবং বাল্ক জাহাজ বেশি ভেড়ানোর সুযোগ দেয়া হবে। এতে জাহাজের নিজস্ব ক্রেন দিয়ে পণ্য লোডিং ও আনলোডিং করা যাবে। বর্তমানে সিসিটি ও এনসিটি টার্মিনালে ‘কী গ্যান্ট্রি ক্রেন’ থাকলেও জিসিবিতে (জেনারেল কার্গো বার্থ) কী গ্যান্ট্রি ক্রেন না থাকায় গিয়ারড জাহাজ দিয়ে পণ্য লোডিং ও আনলোডিং করা হয়ে থাকে। তবে পিসিটি চালুর মাধ্যমে বন্দরে আসা জাহাজগুলোর অবস্থান সময় ( টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম) কমে আসবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহসানুল হক চৌধুরী বলেন,‘ নতুন একটি টার্মিনাল চালু অবশ্যই শুভ সংবাদ। এতে জাহাজ ভেড়ানোর জায়গা বাড়বে এবং বেশি জাহাজকে একসাথে সুযোগ দেয়া যাবে। ফলে জাহাজগুলো দ্রুত পণ্য লোডিং ও আনলোডিং করে বন্দর ছেড়ে চলে যেতে পারবে।’
তিনি আরো বলেন, যেহেতু পিসিটিতে নিজস্ব ইকুইপমেন্টের ঘাটতি রয়েছে সেক্ষেত্রে গিয়ারড জাহাজ ও বাল্ক জাহাজ এখানে ভেড়ানোর সুযোগ পেলে অন্যান্য টার্মিনালগুলো (সিসিটি ও এনসিটি) গিয়ারলেস জাহাজ ভেড়াতে পারবে। এতে বন্দরের কাজেও গতি আসবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে সবচেয়ে পারদর্শী সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড। দীর্ঘদিন ধরে দক্ষতার সাথে হ্যান্ডেলিং কার্যক্রম পরিচালনা করে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘পিসিটির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে বাল্ক জাহাজ ভেড়ানো যেতে পারে। এতে বাল্ক পণ্যবাহী যেসব জাহাজ বহিনোর্ঙ্গরে অপেক্ষায় থাকে সেগুলো দ্রুত পণ্য খালাস করার সুযোগ পাবে। ইয়ার্ড প্রস্তুত হয়ে গেলে গিয়ারড জাহাজ ভেড়ানোর মাধ্যমে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংও সম্ভব হবে।’
তিনি আরো বলেন, পিসিটি চালু হলে বন্দরের প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়বে তেমনিভাবে দেশের অর্থনীতিও বেগবান হবে।
পিপিপির আওতায় যাবে পিসিটি
সরকার ইতিমধ্যে ১৪৪৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে অপারেশন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর অপারেশনের দায়িত্ব যে পাবে সেই প্রতিষ্ঠানই ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করবে। প্রাথমিকভাবে চারটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নাম শোনা গেলেও এখনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত মনোনীত করা হয়নি। তবে পিপিপির আওতায় প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত হওয়ার আগে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পিসিটি পরিচালনা করবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের ইক্ইুপমেন্ট বহরে থাকা অতিরিক্ত রাবার ট্রায়ার গ্যান্ট্রি ক্রেন, রিচ স্টেকার, ফর্ক লিফটসহ বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট পণ্য হ্যান্ডেলিংয়ে ব্যবহৃত হবে।
সবচেয়ে বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে পিসিটিতে
বর্তমানে বন্দরের বিদ্যমান জেটিগুলোতে ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। ইতিমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ সিসিটি ও এনসিটিতে ড্রাফট বাড়িয়ে ১০ মিটারে উন্নীত করতে যাচ্ছে। অপরদিকে পিসিটিতে ১০ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। পিসিটির আরেকটি বাড়তি সুবিধা হলো বন্দরের মেইন জেটিতে জাহাজ আসতে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীর ভেতরের দিকে আসতে হয়, বিপরীতে পিসিটিতে মাত্র ছয় কিলোমিটার আসতে হবে। এছাড়া একটি বিপজ্জনক বাঁকও পার হতে হবে না। ফলে জাহাজগুলো দ্রুত পণ্য খালাস করে বন্দর ছেড়ে যেতে পারবে।
প্রকল্পের ইতিবৃত্ত
ড্রাইডক প্রান্ত থেকে বোট ক্লাবের আগ পর্যন্ত অংশে নির্মাণাধীন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের জেটির দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার। পতেঙ্গা বোট ক্লাব ও চিটাগাং ড্রাইডকের মধ্যবর্তী ২৬ একর জায়গায় চারটি জেটির সমন্বয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে পিসিটি। এরমধ্যে তিনটি জেটি ( প্রতিটি ২০০ মিটার দীর্ঘ) হবে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য এবং বাকি একটি ডলফিন জেটি ( ২২০ মিটার দীর্ঘ)। ডিপিএম (সরাসরি সংগ্রহ পদ্ধতি) পদ্ধতিতে এই প্রকল্পের কার্যাদেশ পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ২০১৭ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু করলেও গত বছরের শুরুতে তা চালুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তা ডিসেম্বরে চালুর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ডিসেম্বরেও তা সচল করতে না পারার পর এবার জুনে চালুর ঘোষণা দেয়া হলে তা জুলাইতে এসে পরীক্ষামূলকভাবে সচল হচ্ছে।