হঠাৎ বেড়েছে মৃত্যু

১৩ দিনে মারা গেলেন ৪০ করোনা রোগী, পাঁচ ধরনের রোগীর মৃত্যুহার বেশি #

ভূঁইয়া নজরুল »
১৮ বছর বয়সী তানজিনার কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হতো। অধিকন্তু আক্রান্ত হয়েছে করোনায়। দুটি বড় ধাক্কা সামলাতে না পেরে জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে বৃহস্পতিবার মারা যায় মেয়েটি।
শুক্রবার দুপুরে মারা গেলেন ৫৩ বছর বয়সী মনজুর মোর্শেদ। তিনি ২১ দিন ধরে জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শুক্রবার সকালে উনার সামনে একজন রোগী মারা যান, এ ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে স্ট্রোক করেন মনজুর। তাকে আইসিইউতে নেওয়ার পর দুপুরে মারা যান। গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামে এভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সিভিল সার্জন থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১৬ মে পর্যন্ত চট্টগ্রামের যেখানে মারা যাওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৩২, সেখানে শুক্রবার তা ৭২ জনে এসে পৌঁছে। ১৩ দিনের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশি (৪০ জন) রোগী মারা গেল।
সামনে কঠিন সময়
এদিকে সামনে আরো বেশি মৃত্যু ও আরো বেশি দুর্যোগ অপেক্ষা করছে এমনই আশঙ্কার কথা জানালেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘এখন তো মানুষ হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে পারছে। আগামীতে অনেক মানুষ হাসপাতালে আসার আগেই মারা যাবে।’
কেন এমন হবে, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালগুলোতে জায়গা থাকবে না। শয্যা তো দূরের কথা হাসপাতালের ফ্লোরেও জায়গা দিয়ে ট্রিটমেন্ট পাওয়া যাবে না। এখনো অনেক মানুষ পরীক্ষা করতে পারছে না। আমাদের হাসপাতালে রোগী এসে ভরে গেছে কিন্তু পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। আবার অনেকে পরীক্ষা করানোর জন্য আসতে পারছে না।’
এখন মৃত্যু বেশি হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথমদিকে রোগটা এতটা প্রকট আকার ধারণ করেনি। সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে এর প্রকটতা। রোগী বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতে শয্যা সঙ্কটও বাড়ছে। এতে চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া নিয়েই সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।
চিকিৎসা সেবা পাওয়া নিয়ে একই সংশয় প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির, যিনি নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসোলেসনে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সামনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। কারো স্বাস্থ্যবিধি না মানার খেসারত দেব আমরা। এতো মানুষের চিকিৎসা সেবা কীভাবে দেয়া হবে! হাসপাতালগুলোতে জায়গার সংকুলান না হওয়াসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে।
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণরাই মারা যাচ্ছে বেশি
চট্টগ্রাম মেডিক্যোল কলেজের হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রিজোয়ান রেহান বলেন, ‘শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যা যাদের রয়েছে তারা করোনায় সবচেয়ে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব রোগ যাদের শরীরে রয়েছে তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। আর এখন যারা মারা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগের করোনার পাশাপাশি এসব রোগ ছিল। এধরনের রোগ যাদের রয়েছে তারা করোনার প্রথম টার্গেট।’
গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব। তিনি বলেন, ‘আমরা এপর্যন্ত অনেক রোগীকে সুস্থ অবস্থায় বাড়িতে পাঠিয়েছি। কিন্তু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যা যাদের ছিল তাদের মৃত্যু হার বেশি দেখেছি।’
তিনি আরো বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনায় এই পাঁচ রোগে মৃত্যু হার বেশি। আর সাধারণত গাণিতিক হিসেবে আক্রান্ত রোগীর পাঁচ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে থাকে। সেই হিসেবে হয়তো এখন মারা যাওয়াটা চোখে পড়ছে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি মারা যাওয়া দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপ এসআলমের পরিচালক মোরশেদ আলমও হৃদরোগী ছিলেন, উনার হার্টে একটি রিং পরানো ছিল। তিনি জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যান।
এক প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সাত থেকে আট শতাংশ হারে মানুষ মারা গেছে। তাদের দেশে সব ধরনের সাপোর্ট থাকার পরও মৃত্যু হার এতো বেশি। সেই হিসেবে আমাদের অবস্থান এখনো এতোটা খারাপ হয়নি। তবে ভবিষ্যতে খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। একইসাথে আমাদের করোনা পরীক্ষা বাড়ানোর পাশাপাশি আইসোলেশন বাড়াতে হবে।
এদিকে করোনা পরীক্ষায় সামনের সারির যোদ্ধা ফৌজদারহাট বিআইটিআইডির ল্যাব প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় এখন ওই ল্যাবে তিন দিনের জন্য পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এখন শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালের ফ্লু কর্নারে নমুনা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বন্দর ভবনে নির্ধারিত দিনে নমুনা নেয়া হয়।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে এপর্যন্ত করোনা রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৪২৯ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৯৭ জন।