রুশো মাহমুদ »
সময়টা বেশ আগের। চট্টগ্রাম চেম্বারের নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন ডাকসাইটে ব্যবসায়ী ও জাঁদরেল রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। ভোটের যে মূল্য। ভোটারের যে মর্যাদা। ওই নির্বাচনে তিনি তা দেখিয়েছেন! তাঁর যে ভোট পাওয়ার চেষ্টা সেটা ভুলি কী করে! একটি ভোটও ওনার কাছে ছিল মহামূল্যবান।
সেই একটি ভোটের কথাই এখানে বলতে চাই। দিনক্ষণ মনে নেই, তবে সালটা মনে আছে। ১৯৮৫ সালের কোন এক মধ্যাহ্নে কমার্স কলেজ ক্যাম্পাসে হাজির সদ্য বিদায়ী চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের দু-দুবারের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির। আমাকে পাকড়াও করে একটা বেবি ট্যাক্সিতে তুললেন। বললেন যেতে হবে। কোথায় বললেন না, শুধু বললেন ট্যাক্সিতে ওঠ। সুবোধের মতো সঙ্গী হলাম নাছির ভাইয়ের। এপথ ওপথ হয়ে ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো বান্ডেল রোডের একটি অফিসের সামনে। নামলাম এবং তাঁর পেছনে পেছনে একটি চেম্বারে ঢুকলাম। ঢুকেই দেখি মস্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপ্রান্তে বসে আছেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। সবার কাছে বাবু ভাই নামেই পরিচিত তিনি। নাছির ভাই সালাম দিয়ে বাবু ভাইকে বললেন, এই ছেলে আমাদের পার্টি করে। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। চেয়ারের পাশে কাছে টেনে একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমার বাবার অফিসের ফোন নাম্বার দাও। ফোন নাম্বার পেয়ে অপারেটরকে বললেন ফোন লাগাতে। বাবাকে ভাইসাহেব সম্বোধন করে বললেন, আমি ও আপনার ছেলে একই পার্টি করি। চেম্বার ইলেকশন করছি, মেহেরবানি করে আমাকে একটা ভোট দেবেন।
আমি হতভম্ব। কিছুটা ভয়েও কাতর। বাসায় ভাববে পড়ালেখা বাদ দিয়ে আমি রাজনীতি করে বেড়াচ্ছি। তবে ভোটারের মর্যাদার সেই ঘটনা এতটা বছর পরও আমাকে আলোড়িত করে।
পঁচাশির সুবাতাস ক্রমে ক্রমে হারিয়ে গেছে। দিন যত গেছে চেম্বারে বেড়েছে দখলদারিত্ব। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় এই প্ল্যাটফর্ম মর্যাদা আর জৌলুস হারিয়ে প্রায় বিবর্ণ এখন। চেম্বারের নির্বাচনকেন্দ্রিক অপচর্চার শুরুটা ছিলো জোর-জবরদস্তি আর দখলদারিত্বের। জনা চারেক ব্যক্তির পকেটে ছিল শত শত ভোট। তখন ট্রেড লাইসেন্স করা অনেক সহজ ছিল। সেই সুযোগ নিয়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ভোটার বানিয়ে চেম্বারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ট্রেড লাইসেন্স প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যাওয়ার পর চেম্বারের লোকদেখানো নির্বাচনও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর চল শুরু হলো সিলেকশনের। শেষবার কখন চেম্বারের নির্বাচন হয়েছে কেউ আর এখন মনে করতে পারে না। যেন সিলেকশনের কাছেই পরাজিত ইলেকশন।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট যিনি একজন এমপি, চেম্বারের নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে তিনিই নির্ধারণ করছেন। তাঁর বলয়ের বাইরের কেউ চেম্বারের পরিচালক হতে পারেন না। শেষ দশ বছর যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন শুধুমাত্র এমপি সাহেবের বদান্যতায় চেম্বারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পাঁচ টার্ম ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন।
চেম্বারের প্রেসিডেন্ট বা পরিচালক হতে কোন ক্যারিশমা বা জনপ্রিয়তার দরকার হয় না। জায়গামতো গুঁজে দিতে পারলে বা আত্মীয়তা থাকলেই কেল্লা ফতে! যোগ্য লোক যে কমিটিতে নেই তা বলছি না। আছে, কমিটির শোভা বাড়াতে বাধ্য হয়ে রাখা হয়েছে কয়েকজনকে বড় কর্তার সম্মতিতে।
চেম্বারের নতুন কমিটি এবার প্রকটভাবে আত্মীয়তার দোষে দুষ্ট। বড় কর্তার স্ত্রীর মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে ছেলেকে বানানো হয়েছে প্রেসিডেন্ট। বিদায়ী প্রেসিডেন্টের কন্যাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট আর আপন ভাইকে করা হয়েছে পরিচালক। নির্বাচনী বোর্ডর প্রধানের মেয়ে জামাই ও ছেলেকে করা হয়েছে পরিচালক। দীর্ঘদিন ধরে থাকা কিছু চেনামুখ পারমেনান্টলি পরিচালক পদ কৃতিত্বের সাথে ধরে রাখতে পেরেছেন।
চরম আত্মীয়করণের ফলে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। শুরু হয়েছে নিজেদের মধ্যে মতদ্বৈততা। গত ১৩ সেপ্টেম্বর চেম্বারের পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন শিল্পপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। যে ক’জন ভালো ও যোগ্য পরিচালক আছেন, তিনি তাদের মধ্যে একজন। গুঞ্জন আছে আরো পদত্যাগের। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থেকে চেম্বারের বের হয়ে আসাটা জরুরি।