সুপ্রভাত ডেস্ক »
ঐশীর জন্মের পর থেকে আরও অন্তত ১ কোটি ৭০ লাখ বেড়েছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা। এটি দেশে প্রজনন হার বা সন্তান জন্মদানের হার কমে আসারই প্রতিফলন। আগে বাংলাদেশের জন্মহার ছিল খুবই উচ্চ। প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিবার পরিকল্পনার ধারণা ও সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে এটিকে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। একে প্রজনন স্বাস্থ্যে একটি বড় মেডিক্যাল সাফল্যই বলা চলে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) ৮০০ কোটিতে পৌঁছেছে বৈশ্বিক জনসংখ্যা। ৭০০ কোটি থেকে শতকোটি মানুষ বাড়তে সময় লেগেছে মাত্র ১১ বছর। খবর টিবিএসের।
এর পেছনে বড় ভূমিকা আছে, ২০ শতকের মধ্যভাগের বিপুল জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির। তবে এর বার্ষিক হার কমতে শুরু করেছে।
জাতিসংঘের আভাস, একারণে জনসংখ্যা ৯০০ কোটিতে পৌঁছাতে লাগবে ১৫ বছর; আর ২০৮০ সালের আগে হাজার কোটিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা কম বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
তবে বৈশ্বিক মানব সংখ্যা নির্ভুলভাবে গণনা খুবই দুরূহ কাজ। সে অনুসারে, কবে জনসংখ্যা কত শত কোটি হচ্ছে তার নির্ণয়ও নয় সহজ। জাতিসংঘ স্বীকার করছে যে, তাদের হিসাবে, দু-এক বছর এদিক-সেদিক হয়ে থাকতে পারে।
তারপরও আজ ১৫ নভেম্বরকেই বিশ্ব জনসংখ্যার ৮০০ কোটির সীমা স্পর্শের সবচেয়ে সম্ভাব্য দিন হিসেবে প্রক্ষেপণ করছে বিশ্বসংস্থাটি।
এদিন ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার একটি হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করা শিশুকে প্রতীকীভাবে ৮০০ কোটিতম মানব সন্তানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, বিশ্বের জনসংখ্যা পাঁচশ কোটি হওয়ার তারিখ অনুমান করে জাতিসংঘ। আর প্রতীকী হিসাবে, সর্বপ্রথম একটি নবজাত শিশুকে পাঁচশ কোটিতম হিসাবে গণ্য করা হয়। তখন থেকেই একেক শতকোটি পূর্ণ হওয়ার প্রতীক হিসাবে ছয়শ ও সাতশ কোটিতম নবজাতককে চিহ্নিত করা হয়।
এসব শিশুর পরিচয় ও জন্ম ইতিহাস বিশ্ব জনসংখ্যার একেকটি মাইলফলকের সূচক। একইসাথে এটির সূচনার ইতিহাসও পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো
পাঁচশ কোটিতম নবজাতক
১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগ্রেবে জন্ম নেয় একটি শিশু। তার নাম মাতেজ গাস্পার। শিশুটি জন্মের সাথে সাথেই হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ভিড় করেন সাংবাদিক ও বিখ্যাতজনেরা।
ছোট্ট গাস্পার আর সন্তান জন্মদানের পর তার ক্লান্ত মাকে সহ্য করতে হয় এই অনুপ্রবেশ। জাতিসংঘ মহাসচিবের সাথে সেখানে ক্রোয়েশিয়ার বিখ্যাত রাজনীতিকরাও ছিলেন। আর ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ব্রিটিশ কর্মকর্তা অ্যালেক্স মার্শাল। মা ও সদ্যজাত শিশুকে এ ধরনের অনাহূত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলায়- এক ধরনের অপরাধবোধও কাজ করছিল তার মনে।
আসলে শতকোটি তম শিশু নির্বাচনের আইডিয়াটি যারা উদ্ভাবন করেন অ্যালেক্স ছিলেন সেই দলে। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘নানান তথ্যউপাত্ত ও প্রক্ষেপণ দেখে আমরা বুঝতে পারি ১৯৮৭ সালেই পাঁচশ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বিশ্বের জনসংখ্যা। এই আইডিয়াটি (প্রতীকী নবজাত নির্বাচনের) তখনই আমাদের মাথায় আসে’।
‘পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছিল, জুলাইয়ের ১১ তারিখে পাঁচশ কোটিতে পা রাখবে বিশ্বের জনসংখ্যা। ফলে ওই দিনে জন্ম নেওয়া একটি শিশুকে বেঁছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমরা’।
তবে আইডিয়াটি জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিদদের জানাতেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। ‘আমাদের মতো অর্বাচীনদের তারা বোঝাতে চাইলেন, যা করতে চাইছি সে সম্পর্কে আমাদের নাকি কোনো ধারণাই নেই। ওই দিনে জন্ম নেওয়া হাজার হাজার শিশুর মধ্যে থেকে একজনকে বেঁছে নেওয়াটা একদমই ঠিক নয়’।
তবে বারণ না শুনে, আমরা সে কাজটাই করি। আসলে আমরা একটি শিশুর ওপর সংখ্যার প্রতীকী ছাপ রেখেছি মাত্র। ওইদিন জাতিসংঘ মহাসচিব বিশ্বের কোনখানে থাকবেন সেটি জানার পর ক্রোয়েশিয়ার জাগ্রেবকে বেঁছে নেওয়া হয়।
এরপর কেটে গেছে ৩৫ বছর। সেদিনকার সেই শিশুটি আজ বিবাহিত, সুখী দাম্পত্য জীবন রয়েছে তার। আজ তিনি একজন রাসায়নিক প্রকৌশলী। সেলিব্রেটি হয়ে পৃথিবীর আলো দেখলেও- এখন গণমাধ্যমের পাদপ্রদীপ এড়িয়ে চলেন। এজন্য দেন না সাক্ষাৎকার বা মন্তব্য। তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও এজন্য কোনো প্রতিক্রিয়া পায়নি বিবিসি।
এ প্রসঙ্গে অ্যালেক্স বলেন, ‘আসলে এ ধরনের নিভৃত জীবন বেঁছে নেওয়ার জন্য আমি অন্তত তাকে দোষ দেব না। জন্মের প্রথম দিনেই তাকে মিডিয়া সার্কাসের মধ্যে পড়তে হয়’।
মাতেজের জন্মের পর থেকে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়েছে আরও ৩০০ কোটি। তবে আগামী ৩৫ বছরে বৈশ্বিক জনসংখ্যা বাড়বে আর দুইশ কোটি। জনসংখ্যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হার কমে আসার দিকেই এটি নির্দেশ করছে। এরপর এটি আরও নিচের দিকেই যেতে থাকবে।
বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর জন্ম হয় আদনানের। পৃথিবীতে তার আগমনকে স্বাগত জানাতে সেদিন হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান।
বর্তমানে সারায়েভোতে তার মা ফাতিমার সাথে বাস করেন ২৩ বছরের আদনান।
অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছেন আদনান, দেশে চাকরি না পেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোনো দেশে চলে যাওয়ার কথা জানান তিনি। ছয়শ কোটিতম নবজাতকের খেতাব বিশেষ কিছু সুবিধাও দিয়েছে তাকে। যেমন একবার এ সুবাদে সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন ফুটবল সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর।
সাতশ কোটিতম শিশু : সাদিয়া সুলতানা ঐশী
রাজধানী ঢাকার বাইরের একটি গ্রামে মা-বাবার সাথে থাকে সাদিয়া সুলতানা ঐশী। ২০১১ সালের ১১ নভেম্বরে জন্ম নেওয়া ঐশীকে বিশ্বের সাতশ কোটিতম শিশুদের একজন বলে ঘোষণা করে জাতিসংঘ।
১১ বছরের শিশু সাদিয়া ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করে; আবার বাড়ির বাইরে গিয়ে ফুটবল খেলতেও ভালবাসে। তবে তার মা-বাবার আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই তেমন– সংসার চলে শাড়ি ও কাপড়ের ব্যবসায়। সেই ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে করোনা মহামারিতে।
তবে গ্রামে জীবনযাপনের খরচ কম হওয়ায়- এখনও তিন মেয়ের স্কুলের বেতন দিতে পারছেন তারা।
ঐশীর জন্ম কিন্তু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ডাক্তারদের পরামর্শে হাসপাতালে গিয়ে জরুরি সি-সেকশন অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে তাকে জন্ম দেন তার মা।
১১ নভেম্বর রাত ১২টা বেজে ঠিক এক মিনিটে পৃথিবীতে আসে ঐশী। সেদিন স্থানীয় প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা ও সাংবাদিক সেখানে ভিড় করেন। এত মানুষের ভিড়ে পরিবারটি হতচকিত হলেও বেশ খুশিই হয়।
তৃতীয় সন্তান ছেলে হোক-তাই চেয়েছিলেন ঐশীর বাবা। কিন্তু, তিন মেয়েই দারুণ পরিশ্রমী ও মেধাবি হওয়ায়- তাদের নিয়ে উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই তার। ঐশীর সবচেয়ে বড় বোন পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঐশী নিজেও হতে চায় ডাক্তার।
তার বাবা বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের তেমন আর্থিক সঙ্গতি নেই, করোনার পর জীবনধারণ আরও কঠিন হয়েছে। তবে ওর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নপূরণে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব’।
ঐশীর জন্মের পর থেকে আরও অন্তত ১ কোটি ৭০ লাখ বেড়েছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা।
এটি দেশে প্রজনন হার বা সন্তান জন্মদানের হার কমে আসারই প্রতিফলন। আগে বাংলাদেশের জন্মহার ছিল খুবই উচ্চ। প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিবার পরিকল্পনার ধারণা ও সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে এটিকে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। একে প্রজনন স্বাস্থ্যে একটি বড় মেডিক্যাল সাফল্যই বলা চলে।
১৯৮০- এর দশকেও বাংলাদেশে নারীপ্রতি গড়ে ৬ সন্তানের জন্ম দিত। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি হার ১.১১ শতাংশ, যা ২০৪৫ সালে কমে হবে ০.৩৭ শতাংশ।