সড়কে অবাধে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি

রাজিব শর্মা »

নগরীর সড়ক-মহাসড়কগুলোতে অবাধে চলছে লক্করঝক্কর ফিটনেসবিহীন গাড়ি। নিবন্ধিত গাড়ির তালিকা থাকলেও ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ির সংখ্যা কত তার নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই সরকারি বা বেসরকারি কোন সংস্থার কাছে। এ ধরনের যানবাহন অবাধে চলাচলের কারণে সড়ক পথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।

এ বিষয়ে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দেশের সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আমরা প্রধানত দায়ী করছি ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও ফিটনেসহীন ড্রাইভারকে। এরপর দায়ী করছি ফিটনেসবিহীন আইন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদেরকে। যাদের আইনের অপব্যবহারের ফলে দিন দিন দুর্ঘটনা বাড়ছে। দেশের মানুষও আইনের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা হারাচ্ছে। দুর্ঘটনার জন্য এই তিনটা বিষয়ে কেউ তাদের দোষ এড়াতে পারে না।

চলতি বছরের ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ওয়েবসাইটে সর্বশেষ হালনাগাদ করা তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮টি। যা ২০১০ সালে ছিল ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮টি। হিসেব অনুযায়ী, গত এক যুগে (২০১০-২৩) নিবন্ধিত যানবাহন বেড়েছে ৪৪ লাখ ৯হাজার ৬৯০টি।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, নিবন্ধিত গাড়ির মধ্যে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখের বেশি গাড়ি ফিটনেসবিহীন। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে ফিটনেস পরীক্ষা ছাড়া এসব গাড়ির কিছু অংশ নিবন্ধন করে অবাধে রাস্তায় চলছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

জানা যায়, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি। মালিকদের এসএমএস-এর মাধ্যমে ফিটনেস করার তাগিদ, সার্কেল অফিস থেকে নবায়নের ব্যবস্থার পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদ-, কারাদ- ও ডাম্পিংসহ নানামুখী ব্যবস্থা নেওয়ার নানা আদেশ থাকলেও তা চলছে ধীরগতিতে। এসব কার্যক্রম ধীরগতিতে চলার মূল কারণ প্রশাসনিক জটিলতা, আইনের অপব্যবহার, আইন প্রয়োগে অবহেলাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে ফিটনেস সনদ হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নিয়মিত করছেন না বাস মালিকরা। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, চলতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে ৪০২ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৭ জন নিহত, ৬৫১ জন আহত হয়েছে। একই সময় রেলপথে ৪৯টি দুর্ঘটনায় ৫১ জন নিহত, ২৬ জন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ১৬ টি দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত, আহত ৪ জন এবং ৩ জন নিখোঁজ রয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৪৬৭ টি দুর্ঘটনায় ৪৯৬ জন নিহত এবং ৬৮১ জন আহত হয়েছে। এই সময়ে ১৫৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৭২ জন নিহত, ১০৭ জন আহত হয়েছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৮.০৫ শতাংশ, নিহতের ৪২.৭৮ শতাংশ ও আহতের ২৬.৬১ শতাংশ। সংস্থাটির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ৮২৯টি। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৭১৩ জন আর আহত হয়েছে ১২ হাজার ৬১৫ জন। আর ২০২১ সালে দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। যাতে নিহত হয়েছে ৬ হাজার ২৮৪ জন।

সংস্থাটির তথ্যমতে ২০২১ এর তুলনায় ২০২২ এ সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ১ হাজার ৪৫৮টি। পাশাপাশি বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এই একবছরে বেড়েছে ১ হাজার ৪২৯ জন। যেসব ঘটনার জন্য দায়ী করছেন ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অযোগ্য ড্রাইভার ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অবহেলা বলে মনে করে সংস্থাটি।

সংস্থার নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আমরা প্রথমত দায়ী করছি বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশসহ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে অবহেলাকে। কারণ তাদের সামনেই যানবাহনগুলো চলছে।

এসব মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিএ) উপপরিচালক চট্টগ্রাম বরাবর একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক মো. খসরু ভুঞা বলেন, ‘ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলোর কোন পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। রেজিস্ট্রেশনভুক্ত গাড়ির তালিকা আমাদের কাছে আছে। আর গাড়ির ফিটনেস আছে কি না আমরা কেন দেখবো, তা দেখবে ট্রাফিক পুলিশ। আর ফিটনেসবিহীন ড্রাইভারের বিষয়টিও দেখবে তারা। তাদের জিজ্ঞাসা করুন সড়কে কিভাবে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে।’

বিআরটি’র অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আপনারা আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে কথা বলুন।’

বিআরটিএ এর এ কর্মকতার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে সিএমপি ট্রাফিক উত্তর বিভাগের উপপলিশ কমিশনার (ডিসি) জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রাস্তায় চলার জন্য পুলিশ কোন গাড়ির অনুমোদন দেয় না। আর দুর্ঘটনা এড়ানোর ম্যাকানিজম পুলিশের কাছে নেই। তাছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো ধরে রাখার জন্যে কোন ড্যাম্পিং স্টেশন সিএমপির নেই। কাজেই মামলা ও আর্থিক জরিমানা নিয়েই ফিটনেসবিহীন গাড়ি ছেড়ে দেয়া ছাড়া তো কোন উপায় নেই।’