সংযোজিত হয়নি গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম

চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিট

নিলা চাকমা »

হাতে ১০-১৫ টা ফাইল। রোববার (৮ অক্টোবর) চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ‘অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি’ বিভাগে এসেছেন শরিফুল ইসলাম। তার স্ত্রী ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসক জানালেন তার স্ত্রীর বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাতে হবে। যেখানে খরচ পড়বে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। খরচের হিসাব শুনে কৃষক শরিফুল চিকিৎসা করাবেন না বলে জানান। গত এক বছরে চমেক হাসপাতালে ৩০-৩৫ শতাংশ ব্লাড ক্যান্সারের রোগী প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে অসচ্ছল বেশিরভাগ রোগী ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা করাতে পারেননি।

চমেক হাসপাতালে নবনির্মিত ‘ক্যান্সার ইউনিট’ ভবনের কাজ ইতোমধ্যে এগিয়েছে ৫৬ শতাংশ। অথচ ‘বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ এর মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসার সরঞ্জাম এখনও সংযোজন হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। ফলে এ ক্যান্সার ইউনিট থেকে কাক্সিক্ষত সেবা মিলবে না বলে তারা আশংকা প্রকাশ করছেন।

জানা গেছে, অকার্যকর অস্থিমজ্জা থাকা ব্যক্তির দেহে স্বাস্থ্যকর অস্থিমজ্জা স্থাপনের প্রক্রিয়া হলো বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের প্রধান চিকিৎসা বলা হয় এটিকে। চট্টগ্রামে কেবলমাত্র একটি বেসরকারি হাসপাতাল গত বছর থেকে এ সেবা দিচ্ছে। ওই হাসপাতালে গত সাত-আট মাসে ১০০ জন রোগীর ‘বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ করা হয়। প্রতি রোগীর অবস্থাভেদে খরচ পড়েছে ১০-১৫ লাখ টাকা।

গত বছর ভারতের মুম্বাাইয়ে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেন হালিশহরের বাসিন্দা রেশমা আক্তার। তিনি বলেন, আমি যখন বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করি, তখন চট্টগ্রামে কোথাও এ সেবা ছিল না। বাধ্য হয়েই ভারতে করতে হয়েছে। খরচ পড়েছে প্রায় ১৬ লাখের মতো। চমেক হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ ‘ক্যান্সার ইউনিট’ এ কম খরচে সেবা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছেন সাধারণ রোগীরা। যাদের আসলেই এ ব্যয়বহুল চিকিৎসাটি করানোর সামর্থ্য নেই। এ সেবা হাসপাতালে সংযোজন করা খুবই দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।

বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়াও মলিকুলার ল্যাব, ইন্টারভেনশনাল ইমেজিং কনসাল্টেন্ট অ্যান্ড ইউনিট, লিনিয়ার এক্সেলারেটর, ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড এখানে রাখা হয়নি জানালেন একাধিক ‘অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি’ চিকিৎসক।

তারা জানান, ‘আমরা শুনেছি কমপ্রেনহেনসিভ ক্যান্সার কেয়ার ইউনিট করা হবে। যদি তাই হয় তাহলে এখানে ক্যান্সার চিকিৎসার সকল পরীক্ষার নানা সুবিধা পাবেন রোগীরা। হাসপাতালে কমপ্রেনহেনসিভ ক্যান্সার কেয়ার ইউনিট করা হলে রোগীদের আর বিদেশ এবং বেসরকারি হাসপাতালে ছুটতে হবে না।

কিন্ত এই ‘ক্যান্সার ইউনিটে’ নেই বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট, মনিকুলার ল্যাব, ইন্টারভেনশনাল ইমেজিং কনসালটেন্ট অ্যান্ড ইউনিট, ইমারর্জেন্সি রুমসহ আরও বেশ কিছু দরকারি উপাদান। ফলে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার সেবা রোগীরা পাবে না। তাই আমাদের দাবি, এ ইউনিটে সকল আধুনিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হোক।

এছাড়া আলাদা ইমারর্জেন্সি সার্ভিস করার দাবি জানিয়ে তারা জানান, ‘একজন রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, বমি করছে, জরুরি অক্সিজেন দরকার পড়ছে। এরকম অবস্থায় হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে ক্যান্সার ইউনিটে নিয়ে আসা খুবই ভোগান্তি হবে। তার জন্য আউটডোর বা ইমার্জেন্সি খুবই দরকার। এসব সরঞ্জাম ছাড়া ক্যান্সার রোগীরা পূর্ণাঙ্গ সেবা পাবে না। গরিব রোগীদের ব্যয়বহুল স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এসব সরঞ্জাম খুব প্রয়োজন।’

চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সরকার ২০১৯ সালে চট্টগ্রামসহ ৮টি বিভাগীয় শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একশ শয্যার ক্যান্সার ইউনিট স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়। তবে চট্টগ্রামে রোগীর বাড়তি চাপ থাকায় এ ইউনিটটি ১০০ শয্যা থেকে বাড়িয়ে ২শ’ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৫০টি ডায়ালাইসিস মেশিনসহ ১৬৫ শয্যার কিডনি ইউনিট এবং কার্ডিয়াক রোগীদের সেবা দিতে ১১৫ শয্যার জন্য ১৫তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইত্যেমধ্যে ভবনের ৫৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করছে গণপূর্ত বিভাগ।

ক্যান্সার কেয়ার ইউনিটে রয়েছে এমআরআই মেশিন, ১টা লিনিয়ার এক্সেলারেটর, সিটি স্যামুলেটর, ব্র্যাকি থেরাপি, রেডিওথেরাপি ও ২২০ শয্যাসহ আরও কয়েকটি সরঞ্জাম।

চিকিৎসকদের এসব দাবি প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘অধিকাংশ চিকিৎসা সরঞ্জামই এখানে রয়েছে। তারা কোথায় শুনেছে এগুলো এখানে নেই; তা আমি জানি না। এটা ঢাকার প্রকল্প। স্থাপত্য অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে দফায় দফায় বসে এর পরিকল্পনা করা হয়। এখানে আসলে আমরা কিছু কারেকশন করে দিই।

বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি ক্যান্সার রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু সেটি পরিচালনার জন্য আমার তো লোকবল এবং প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন। তা তো আমাদের কাছে নেই। তাই এখন হচ্ছে না। আগামীতে হবে না তা কি কোথায় লেখা আছে। এই মেশিনটি শুধু এখানে নয়, ঢাকাতেও অনেক হাসপাতালেও নেই।’ ইমারর্জেন্সি নিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি হাসপাতালে কয়টি ইমারর্জেন্সি দরকার? এখন হাসপাতালে অনেক বিভাগ রয়েছে। প্রত্যেকের জন্য কি আলাদা ইমারর্জেন্সি করার প্রয়োজন আছে। আউটডোর সেবাতো রয়েছেই। তবে রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী সব হবে। একসাথে তো আর সব করা যায় না।’

নতুন ভবন নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী বছর জুনের মধ্যে কাজ শেষ করে তা বুঝিয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে।’

জানা যায়, প্রথম দিকে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩৮৮ কোটি ২৯ লক্ষ ৮১ হাজার টাকা। পরে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে যায়। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে এর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন মাসে নেওয়া হয়। ভবনটিতে দ্বিতীয় থেকে সপ্তম তলায় ১৮০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যান্সার ইউনিট থাকবে। অষ্টম থেকে এগারো তলায় ১৬৫ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস এবং ১২ তলা থেকে ১৫ তলা পর্যন্ত ১১৫ শয্যার কার্ডিয়াক ওয়ার্ড করা হবে। ভবনটিতে ৯টি লিফটসহ নানা ধরনের সুবিধা থাকবে।’