শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষায় পরিবারের ভূমিকা

অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব »

আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি হল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। সেই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দিন ধরে কোভিড-১৯ এর কারণে বন্ধ। সেই বন্ধের শেষ কবে হবে তা বলা যাচ্ছে না। এতে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তা অপূরণীয়। সেই ক্ষতির কারণে গ্রাম কিংবা শহর সবখানের শিক্ষার্থীরা, শিশু-কিশোররা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শহরের শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটে ক্লাশ করে, পড়ার সুযোগ পায়। তারা সেখানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বা থাকতে পারে। আবার লেখা-পড়ার বাইরের নানা কিছুও অনলাইনে দেখে সময় কাটাতে পারে। তাতে তাদের সাথে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যোগাযোগ কমে যায়। যার জন্য পারিবারিক বন্ধন তথা ভালবাসা, শ্রদ্ধা,আদর ও স্নেহের বেষ্টনী দুর্বল হয়ে পড়ে। একাধিক আপন মানুষ শুধু এক সঙ্গে থাকলে পরিবার হয় না। সে-ই এক সঙ্গে থাকা মানুষগুলোকে আদর-ভালবাসা-শ্রদ্ধার চাদরে মুড়িয়ে বা ঢেকে রাখতে হয়। অনলাইনে আসক্ত হয়ে পড়ায় বা অপ্রয়োজনে ব্যবহার করার ফলে এবং স্কুল কলেজে যেতে না পারায় তাদের মধ্যে এক ধরণের হতাশা-বিষাদ তৈরি হয়। যার জন্য শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ শহরের শিক্ষার্থীরা আবেগিক দারিদ্র্যে পড়ে।
অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষার্থীরা, ছেলেমেয়েরা আর্থিক দরিদ্রতায় আছে। তারা আর্থিক দরিদ্রতার কারণে অনলাইন বা নেটে থাকতে পারে না। আবার নেটের সুবিধা সবখানে না থাকায় কেউ চাইলেও নেটে ক্লাশ করতে পারে না। এই দারিদ্র্য তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়।
অভিভাবকরা ভাবে, এই করোনার সময় বাহিরে ঘোরাফেরা করার চেয়ে ছেলেমেয়েরা অনলাইনে ব্যস্ত থাকা অনেক নিরাপদ । হ্যাঁ, নিরাপদ। প্রশ্ন হলো কোন দিক দিয়ে নিরাপদ। শারীরিক ভাবে নিরাপদ সেটা ভাবা যাচ্ছে। কিন্তু কত দিন এভাবে নিরাপদ থাকা যাবে, -প্রশ্ন সেখানে। আর মানসিক স্বাস্থ্য যে কত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে, শিক্ষায় সুদূরপ্রসারী কত ক্ষতির দিকে যাচ্ছে তা নিয়েও তো প্রশ্ন করা যায়। শিক্ষায় এই ক্ষতি ধীর গতির বলে সহজে প্রত্যক্ষণ করা যাচ্ছে না। তাই এনিয়ে তেমন মাথা ব্যথা হয় না। মাথা ব্যথা থাকলেও শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন ছাড়াও যে আচরণিক বিষয় আছে, আবেগিক বিষয় আছে তা আমাদের ভাবায় না।
শহরের শিশু-কিশোররা আবেগিক দরিদ্রতায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, আর গ্রামীণদের আর্থিক দরিদ্রতা বা নেট না থাকায় লেখাপড়ায় যুক্ত থাকতে না পারায় হতাশায় ভুগছে – এর জন্য শিক্ষায় ও মানসিক গঠনে যে ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে না ভাবলে সে ক্ষতির থাবায় দগ্ধ ক্ষতচিহ্ন দিন দিন বেড়েই যেতে থাকবে।
আর্থিক নিরাপত্তা দেয়া ও কায়িক স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা দেয়ার চেয়ে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করার প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ক) সময় ও নিয়মে অভ্যাস করানো শিক্ষার্থীদের প্রাত্যাহিক কাজগুলো নির্ধারিত সময় ও নিয়মের ভেতর দিয়ে করতে অভ্যস্ত করানো। নির্ধারিত সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ওঠার অভ্যাস করানোর কথাও আছে। তাই সময় অনুযায়ী চলার অভ্যাস করাতে হবে।
খ) অনলাইন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখা- নিয়মে রাখার জন্য, বাসার অনলাইন অনির্ধারিত ভাবে খোলা রাখা যাবে না। অন-অফ রাখার সময়সূচি থাকতে হবে। রাত ১২টার পর সেন্ট্রালি বন্ধ করে দেয়া। সকালে নির্ধারিত সময়ে অনলাইন বা ওয়াই-ফাই খুলে বা অন করে দেয়া। নির্ধারিত সময়ে পড়ার টেবিলে বসার ব্যবস্থা করা।
গ) পারস্পরিক যোগাযোগ ও মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়া –
পারিবারের সদস্যদের নিয়ে এক বেলা হলেও একসাথে খাবার খেতে বসা, সাপ্তাহিক ন্যূনতম একদিন হলেও ঘরোয়া কোন অনুষ্ঠান করা, যাতে সবাইকে নিয়ে কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকা যায়। এতে পরিবারের সদস্যদের প্রতি মনোযোগ দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। পরস্পরকে কাজে সহায়তা করতে পারায় মানসিক চাপ কমে। একাকিত্ব দূর হয়। পারিবারিক আনন্দঘন অনুষ্ঠান মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভাল ফল দেয়। বয়স, সম্পর্ক, রুচি ও চাহিদা বিবেচনা করে এক সাথে গণমাধ্যমের আকর্ষণীয় কোন বিষয় উপভোগ করা । এতে শিক্ষার্থীদের অনলাইন আসক্তি কমে যাবে। মনে রাখা জরুরি, শিক্ষার লক্ষ্য শুধু জ্ঞান অর্জন নয়। আচরণে সামাজিক হওয়া,আবেগিক জগতকে ভালবাসা-স্নেহ-আদর দিয়ে ভরিয়ে তোলা, সংবেদনশীল করাও শিক্ষার লক্ষ্য। যেখানে পরিবারের ভূমিকা মুখ্য। এতে শিশু-কিশোররা মানসিক পুষ্টি পাবে, নেতিবাচক সংবাদ দূষণের চাপে থাকবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন ধরে যেতে না পারায় তৈরি নানা জাড্যতা, নিষ্ক্রিয়তা তাদের মধ্যে তখন থাকবে না। অসহায় ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না।
ঘ) ইতিবাচক আচরণে অভ্যাস করানো-
প্রেষণা বা উৎসাহের জন্য পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়, পাড়া-পড়শির ভাল আচরণ বা গুণের বিষয়গুলো সামনে আনা যায়, আলোচনা করা যায়। বিনোদনের ব্যবস্থাও রাখতে হয়। বিনোদন মানে শুধু শুধু আনন্দ করা নয়। পাক্ষিক বা মাসিক হলেও একবার আনন্দমুখর অনুষ্ঠান করা, বিনোদনের ব্যবস্থা করা যায়। জন্মদিন পালন, স্মৃতিচারণ করা, গল্প বলা, ধারাবাহিক গল্পবলা, দাবা, লুডু, কেরাম, ছক্কা খেলা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। পারলে নিয়মিত ব্যক্তিগত ডায়েরিতে দিনের ভাল-মন্দ লিখানো যায়। এসব আয়োজনে নেতিবাচক নানা ভাবনা থেকে মুক্ত থাকা যায়, দুশ্চিন্তার চাপ কমানো যায়। মানিসিক অস্থিরতাও হ্রাস পায়।
ঙ) শিক্ষার্থীকে শ্রমশীল করা –
করোনা-তাড়িত সময়ে অন্যতম সমস্যা হল শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বা অলসতা।এতে মস্তিষ্কও অলস হয়ে পড়ে। আর অলস মস্তিষ্ক কখনও সৃজনশীল হতে পারে না, নেতিবাচক ভাবনার কারখানা হয়ে উঠে। তাই শিক্ষার্থীকে শ্রমশীল করাও শিক্ষার অন্য একটি লক্ষ্য করা হয়। সেটা ঘর গুছানো থেকে শুরু করে রান্না বান্নার কাজ, বাগান বা ক্ষেতের কাজও হতে পারে। শ্রমশীলতা ও কাজের ভেতর দিয়ে এভাবে নেতিবাচক প্রভাব থেকে করোনা-প্রজন্মকে রক্ষা করার পরিবেশ তৈরি করা যায়। তাই আদের মানসিক ক্ষতির লাগাম ধরার কৃৎকৌশল নিয়ে ভাবা জরুরি।
চ) আদর-ভালবাসাকে কাজে লাগানো-
আমদের সংস্কৃতিতে বা জীবনাচারে শিক্ষাবিজ্ঞানের আলোকে শিশু-কিশোরদের নিয়ে চিন্তাভাবনা নাই। কোন কথা জানালে হয় না,কথাটা কোথায়,কখন বলতে হবে তাও জানতে হয়। তা জানা অভ্যাসের ব্যাপার। তা না হলে সমস্যা তৈরি হয়। আমাদের আদর ভালবাসায় সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থাকতে হয়। তাই সন্তানের চাহিদার কথা বিবেচনা করে আচরণ করতে হয়। যদি কায়িকভাবে আক্রান্ত হয় তাহলে তা সহজে আমাদের মনোযোগ টানে। মানসিক আক্রান্তের বিষয়টা সহজে মনোযোগ টানে না। ফলে সন্তান মানুষ হওয়ার বিষয়টি ঝুঁকির মধ্যে থেকে যায়। সেই দিক দিয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন এবং গুরুত্বও দিতে হবে। সেই জন্য ভালবাসা-আদর থাকবে ঠিক আছে। তবে প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে, নরমও হতে হবে। যেমন সু-অভ্যাস গড়ে তোলার সময় প্রয়োজনে কঠোর হতে হয়।
ছ) শিক্ষার আচরণিক ও আবেগিক লক্ষ্যে মনোযোগী হওয়া-
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা বা অসুবিধার দিক হল, শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা কেন্দ্রিক রাখা ও ভাবা। পরীক্ষার ফলাফল ভাল হওয়া মানেই সব দিক দিয়ে ভাল হওয়া মনে করি। তাই কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাশ হয় কি না, শিক্ষকরা ক্লাশে আন্তরিক কিনা, নোট-গাইড- কোচিং নির্ভর কিনা ইত্যাদি বিবেচনায় রাখি না। নামিদামি অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে দেখেছি (আমার নিজেরও দুই/একজন ছেলেমেয়ে আছে) তারা প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাশে যায় না বা তাদের যেতে হয় না।। কোন মতে পাঠ্যপুস্তকের বা গাইড-সাজেশন্স নিয়ে ব্যস্ত থাকলে হল । জিপিএ ফাইভ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেই হল বা তা নিশ্চিত করায় ব্যস্ত রাখতে পারলেই হল। শিক্ষার তো সেটি ছাড়া তথা জ্ঞানী করা ছাড়া আরও দুটি লক্ষ্য থাকে। সেগুলো হল আচরণিক লক্ষ্য ও আবেগিক লক্ষ্য। লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথে শিক্ষার্থীকে রাখা গেলে সে ভাল মানুষ হয়ে ওঠে। ভাল মানুষ হয়ে ওঠা আর জিপিএ ফাইভ পাওয়া,আগে কোনটা পরে কোনটা সেই বিতর্ক অন্য সময়ে।
আমরা মানসিক ক্ষতির কথা বিবেচনা করি না,শুধু জ্ঞান অর্জনের কথা ভেবে যাই। শিক্ষার লক্ষ্য তো শিক্ষার্থীকে সামাজিক করে তোলা, আর সামাজিক হতে হলে তো সমাজে থাকতে হবে, মিশতে হবে। সেই থাকা বা মেলামেশা শুরু হয় পরিবার থেকে। যেখান থেকে আচরণিক লক্ষ্য অর্জিত হয়। তাই ওপরে বলা হয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে শিশু-কিশোর বান্ধব পরিবার করা। তাতে পরিকল্পিত সময় দেয়া এই করোনা-তাড়িত সময়ে জরুরি। পরিবার যে দৃষ্টিকোণ থেকে শিশুকে দেখে, শিশু সেই ভাবে বেড়ে ওঠে। পারিবারিক যে আচরণের জলবায়ুতে বড় হয় সেই অনুযায়ী তার আচরণের প্রকাশ ঘটে, ভালবাসা নির্মিত হয়। এই সব তো শিক্ষাবিদরা বলে গেছেন। শিশু-কিশোরের জ্ঞানবিকাশের বায়ো-ইকোলজিক্যাল ভাবনায় পারিবারিক তথা বাবা-মা,ভাই-বোন, নিকটাত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী খেলার সাথী ইত্যাদি থেকে জ্ঞান বিকাশ,সামাজিক বিকাশ ও আবেগিক বিকাশের প্রাথমিক কাঠামো ও হাতিয়ার বা দক্ষতা তৈরি হয়। অনেকটা বহুতল ভবনের বেইজ ঢালাই এর মত। এই জায়গাটাতে তো আমরা পরিকল্পিত সময় দিতে পারি, এই করোনা-তাড়িত সময়ে।
আলোচনায় এটাই বুঝতে পারা গেল যে, প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্জা, তুফান, ঝড়বৃষ্টি থেকে পরিবারের সদস্যদেরকে রক্ষা করার জন্য, নিরাপত্তার জন্য আমরা ঘর তৈরি করি। সুরক্ষার জন্য ঘরবাড়ি প্রয়োজনে সংস্কার করে চলি। করোনা-তাড়িত অবরুদ্ধ এই বৈরী সময়েও তেমনি শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। তা লাঘব করতে পারে, পারবারিক সচেতনতা। পরিকল্পিত ও উপযুক্ত ভাবে সময় দেয়া। তাতে শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যে আদর-যতœ-ভালবাসার চাদর তৈরি হবে সেই চাদরই আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক বড় ধরণের ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে। আর আবেগিক-আচরণিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে ভাল মানুষ হয়ে ওঠার প্রত্যাশা পূরণ হবে। এই ভাবে পারিবারিক মানসিক স্বাস্থ্য এই দীর্ঘ বন্ধের সময়ে রক্ষা পাবে। তাতে বাড়ির রুটিন অনুযায়ী লেখাপড়া ও অন্যান্য কিছু করা ও করানো সহজ হবে। এতে শিক্ষায় ও মানসিক যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে তা থেকে করোনা-প্রজন্মকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তক
অধ্যক্ষ-খলিলুর রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজ