শহরে বসবাসকারীদের জন্য নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবা

আবুল ফয়েজ মো: আলাউদ্দিন খান »

অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং প্রবৃদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই গ্রাম থেকে শহর অভিমুখী জনসমাগম বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ বর্তমানে শহরে বসবাস করছেন। ২০৪০ নাগাদ এটি ৫০ ভাগে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এই যে ক্রমবর্ধমান শহরমুখী জনস্রোত, তার বেশির ভাগই প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। তারা শহরে আসছেন পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তার আশায়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে অনেক উন্নত সেবাসমৃদ্ধ শহরে তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসত গড়ে থাকছেন এবং তাদের অনেকে অপুষ্ট শরীরে বিরামহীনভাবে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার চেষ্টা করছেন।
এই মানুষদের অনেকে তাদের শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ রেখে শহরে চলে এসেছেন এবং অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের শারীরিক সামর্থ্যই তাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকায় এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। শ্রমজীবী শ্রেণির এই বিশাল অংশকে এমন ঝুঁকিতে রেখে টেকসই অর্থনীতি কী গড়ে তোলা সম্ভব? উৎপাদনের হাতিয়ার এই কর্মজীবী জনগোষ্ঠী অসুস্থতায় ভুগলে কিংবা দুর্বল হয়ে পড়লে জাতীয় উৎপাদনশীলতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলাই যায়।
কাজেই, অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে শহরবাসীর মধ্যে যারা অসচ্ছল শ্রমজীবী নারী-পুরুষ এবং তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য যেমন শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা জরুরি। প্রশ্ন হলো এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে?
শহরগুলো জনাকীর্ণ সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ব্যয়বহুল বেসরকারি ক্লিনিক এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার দিয়ে ভরপুর। দরিদ্র পরিবারের জন্য বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবা গ্রহণ বিলাসিতার মতো। তাই অনেকেই পাড়া-মহল্লার ঔষধের দোকানে যান কিন্তু সেখান থেকে কি আসলেই আরোগ্য মেলে? হয়তো স্বল্পকালীন স্বস্তি পাওয়া যায়, কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় যেকোন অবহেলা কেবল সুপ্ত রোগের মাত্রা বাড়িয়েই দেয় না বরং ভবিষ্যতে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও তৈরি করে। কে না জানেন যে রোগের ঝুঁকি বাড়ার সাথে সাথে চিকিৎসা ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯৭৮ সালে বিশ^স¦াস্থ্য সংস্থার আলমা আতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। সর্বজনীন স্বীকৃত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বলতে আমরা বুঝি সহজলভ্য শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য সেবা, পুষ্টির মান উন্নয়ন, পরিবার পরিকল্পনা, বয়োসন্ধিকালে স্বাস্থ্য পরিচর্যার উপকরণ, প্রতিষেধক টিকা, স্বল্প আঘাত ও সাধারণ অসুস্থতার চিকিৎসা, সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ এবং মহামারি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ যে কয়টি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতিসাধন করেছে তার মধ্যে গ্রামীন পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা অন্যতম। তবে শহরাঞ্চলে স্বল্প আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল।
বর্তমান সরকার, তার পূর্বের শাসনামলে ১৯৯৮ সালে বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে আরবান প্রাইমারি হেল্থ কেয়ার প্রজেক্ট শুরু করে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০১২ সালে এর দ্বিতীয় পর্যায় শেষ করে কোন বিরতি না রেখেই আরবান প্রাইমারি হেল্থ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট (ইউপিএইচসিএসডিপি) নামে বিস্তৃতি লাভ করে। বর্তমানে ইউপিএইচসিএসডিপি এর দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পটির অধীনে ১১টি সিটি কর্রপোরেশন এবং ১৩টি পৌরসভা এলাকায় ৩৮টি মাতৃসদন, ১৫০টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ৩০০টি স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শহরবাসী, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মা ও শিশুদের স্বল্পমূল্যে উন্নত প্রাথমিক চিকিৎসা এবং রোগ প্রতিরোধী সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতিদরিদ্রদের মধ্যে ২ লক্ষের বেশি (মার্চ, ২০২২ পর্যন্ত) লালকার্ড বিতরণ করে তাদের বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের শহরাঞ্চলের ১ কোটি ৭০ লক্ষের বেশি মানুষ বর্তমানে এ প্রকল্পে সেবার আওতাভুক্ত।
ব্যয়বহুল চিকিৎসাকেন্দ্রের ভিড়ে শহরে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠী কোথায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন এমন প্রশ্নের জবাবে জানাতে চাই, ‘সেবার আলো সবার কাছে’ স্লোগানে উদ্দীপ্ত ইউপিএইচসিএসডিপিভুক্ত রংধনু চিহ্নিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রয়েছে। এখন প্রকল্পের কার্যকারিতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রয়োজন জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। জনগণকে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য জনসচেতনতা তৈরিতে অভিজ্ঞ বিসিসি ফার্মকে সরকার নিয়োগ দিয়েছে। তাদের উদ্ভাবনীমূলক কর্মকা-ের কারণে দিনে দিনে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ক্লিনিকে সাধারণ রোগীদের জন্য ডাক্তারের কনসাল্টেশন ফি ৫০ টাকা। নরমাল ডেলিভারি চার্জ ১২০০ টাকা এবং সিজারিয়ান ডেলিভারি চার্জ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ ফ্রি। এছাড়াও লালকার্ডধারীদের চিকিৎসা বিনা পয়সায় প্রদান করা হয়।
প্রকল্পটি যে ঋণের টাকায় পরিচালিত হচ্ছে সেটা জনগণের কর থেকেই পরিশোধ করা হচ্ছে। সুতরাং, প্রকল্পের যে লক্ষ্যÑ শহরবাসী দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার কলেবর বৃদ্ধি এবং দক্ষ, মানসম্মত ও টেকসই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন, তা পূরণকল্পে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর প্রতি সুবিধাভোগী জনগণের মালিকানাবোধ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সামাজিক চাহিদা তৈরি হলে এর মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় রসদের সংস্থান হবে সামাজিকভাবেই। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা খুবই জরুরি। উল্লেখ্য, প্রকল্প এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে ওয়ার্ড আরবান হেল্থ কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করা হয়েছে যার কাজ হলো স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে দীর্ঘস্থায়ীকরণে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং সেবাগ্রহণ ও প্রদানের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে সমাধান করা। জনপ্রতিনিধি এবং সচেতন ব্যক্তিমাত্রই অবগত আছেন যে, স্বাস্থ্যসেবার মত মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সমাজে জনভিত্তি মজবুত করা সম্ভব। তাদেরকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
সমাজের সকল অংশে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে একটি সুস্থ জাতিগঠন সরকারের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ। কারণ, একটি সুস্থ জাতিই কেবল নিজেদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন টেকসই রাখতে পারে।

লেখক : অতিরিক্ত সচিব ও প্রকল্প পরিচালক