শরতে দোলনচাঁপার সৌরভ

ফুলের গুচ্ছ লম্বা হয় ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার

হুমাইরা তাজরিন »

‘যেন দেবকুমারীর শুভ্র হাসি,ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি’- দোলনচাঁপা ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর পংক্তিগুলোই লিখেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এতেই থেমে থাকেননি কবি। নিজের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থকেই দিয়েছেন ‘দোলনচাঁপার’ নাম। এই নামে সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য রাগ। এমনকি প্রিয়তমার নাম রেখেছেন দোলনচাঁপা। এ যেন সৌন্দর্য আবিষ্কারের আনন্দ। যদি দোলনচাঁপার সৌন্দর্য দর্শন ও সৌরভ গ্রহণের সৌভাগ্য হয় এই আনন্দ যেকোনো মানুষের জন্য হতে পারে সংক্রামক। শরতের শুভ্র মৌসুমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে এই অনিন্দ্য ফুলটি ছড়াচ্ছে সৌরভ।

দোলনচাঁপা। যার বৈজ্ঞানিক নাম হেডিসিয়াম কোরোনারিয়াম। জানা যায়, হেডিয়াস শব্দটি এসেছে দুটি গ্রীক শব্দ ‘হেডিস’ (মিষ্টি) এবং ‘সিয়াস’ (তুষার) থেকে। এর সৌরভ আর বর্ণেও কারণেই এই ধরণের নামকরণ করা হয়েছে। এই ফুলটির রয়েছে ৪০টি প্রজাতি। আদিতে ভারতবর্ষেও ফুল হলেও এটি ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্নস্থানে বিস্তার লাভ করেছে। যেমন এর মধ্যে নেপাল, মায়ানমার,থাইল্যান্ড তাইওয়ান, ফ্লোরিডা, ক্যারাবিয়ান অঞ্চল, গল্ফ কোস্টসহ ক্রান্তীয় ও উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চল। এটি ইউরোপ আমেরিকার ঠান্ডা অঞ্চলেও জন্ম লাভ করে। তবে শীতকালে গাছটি মারা যায় এবং গ্রীষ্মকালে পুনরায় গজিয়ে ওঠে। চীনারা ঔষধ তৈরি এবং সুগন্ধি তেল তৈরির জন্য এই ফুলটি বহুদিন ধরে চাষ করে যাচ্ছে। ভারতের মণিপুরে একে ডাকা হয় তখেল্লৈ অঙৌভা নামে, মারাঠিরা ডাকেন সোনটাকা নামে এবং আসামে এটি পরিচিত সুরুলি সুগন্ধিনামে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে এই ফুলটি তোড়া করে বিক্রয় করা হয়ে থাকে। নগরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাসিা বাড়িতে বিশেষ যতেœ এই ফুলের গাছ লাগিয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে নগরীর দক্ষিণ খুলশীর পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিি , কাজির দেউরির সুগন্ধা সিনেমা হলের সামনে, ২ নম্বর গেইট বিপ্লব উদ্যানসহ বেশ কিছু ফুলপ্রেমী বাগানীদের আবাসিক বাগানে স্থান করে নিয়েছে এই শ্বেতাঙ্গিনী। তবে ফুলটিকে জাতীয় ফুল হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে কিউবা।

ব্রাজিলে ক্রীতদাসযুগে প্রথম এই ফুলটির আগমন ঘটে। ক্রীতদাসেরা ঘুমানোর জন্য এই ফুলের গাছকে তোষক হিসেবে ব্যবহার করতো। তবে একটু আক্রমণাত্মক এই গাছটি অন্যান্য গাছের অনেক সময় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাই হাওয়াই এবং ব্রাজিলের মতো বেশকিছু জায়গায় এটিকে ‘ রাক্ষুসে অগাছা’ বলেও ডাকা হয়।

এই গাছ আদার মতো রাইবোজম বা কন্দ থেকে গজিয়ে ওঠে। এই জন্য একে হোয়াইট জিঞ্জার লিলিও বলা হয়। উচ্চতায় ১ থেকে ২ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকেভ পাতার আকার স্বভাবত ২০ থেকে ৬১ সেন্টিমটার পর্যন্ত লম্বা এবং ৫ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার চওড়া হয়ে থাকে। গ্রীষ্ম থেকে শরৎকাল পর্যন্ত এই ফুল ফোটে থাকে। সন্ধ্যার দিকে এই ফুলগুলো ফুটে থাকে। ফুলটিতে থাকে চারটি পাপড়ি। মনে হবে শুভ্র প্রজাপতি ডানা মেলে আছে। এই কারণে ফুলটিকে বাটারফ্লাই লিলিও বলা হয়ে থাকে। ভীষণ মিষ্টি এই ফুলের সুবাস যা সকলকে বিমোহিত করে। গ্রীষ্মের মধ্যভাগ থেকে বসন্ত পর্যন্ত অগ্রভাগে ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি পরিমাপে মোচা হয়ে থাকে। এই মোচার ভিতর থেকেই জন্ম নেয় ৭ থেকে ১২ টি ফুলের কলি। ধারাবাহিকভাবে ফুটতে থাকে সাদা পাপড়িযুক্ত ফুলগুলো। একটি গাছে এক সঙ্গে ১ থেকে ৩ টি ফুল ফুটে থাকে। ফুলের গুচ্ছ লম্বা হয় ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।

দীর্ঘজীবী এই ফুলটি বিপুল প্রাণশক্তি সম্পন্ন। শীতকালে এই গাছের কা- মরে গিয়ে গাছ শুকিয়ে যায়। কিন্তু অবিনাশী দোলনচাঁপা গ্রীষ্মে পুনর্জন্ম লাভ করে। একবার যদি এই ফুলের গাছ রোপণ করা হয় তাহলে ধীরে ধীরে এর চারা বাড়তে থাকে। এক সময় পরিণত হয় বিশাল ঝোঁপে। তীব্র আলোতে এর বর্ধন ব্যাহত হয়। অথচ ছায়াময় শীতল আলোর সঙ্গে এই উদ্ভিদের ভীষণ সখ্য। সমতল এবং পাহাড় দুই অঞ্চলে এই উদ্ভিদের সমান দাপট লক্ষ্য করা যায়।