ভূমিকম্পের ঝুঁকি এড়াতে পূর্ব পরিকল্পনা জরুরি

রায়হান আহমেদ তপাদার »

ভূতাত্ত্বিক ও ভূমির গঠন অনুসারে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশ ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। এর মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প ও ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। বাংলাদেশের অভ্যন্তর ও চারপাশে বেশ কিছু সিসমিক গ্যাপ আছে। একে ভূমিকম্পের উৎসস্থল বলা হয়। ভূতত্ত্ববিদ ও সিসমোলজিস্টদের হিসাব মোতাবেক, বাংলাদেশে যেকোনো সময় মাঝারি কিংবা বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। এ জন্য আমাদের কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনই বাড়ানো দরকার। এ ধরনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ভূমিকম্প দুর্যোগের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারব। ভূমিকম্প সৃষ্টির প্রধান কারণ হল পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের শিলাখ-ের স্থিতিস্থাপকীয় বিকৃতি। তদুপরি বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্প সৃষ্টির অন্য এক কারণও উদ্ভাবন করেছেন, সেটা হল-জলাশয় বেষ্টিত কম্পন। ভারতের মহারাষ্ট্রের শিবাজিসাগর জলাশয়ের সন্নিকটবর্তী অঞ্চলে ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ৬.৫ রিখটার স্কেলের মাপে বেশ কয়েকটা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বিশ্বের বেশ কিছু জলাশয় অঞ্চল যেমন- ভাগরাও লেক (সুইজারল্যান্ড), মারাথান লেক এবং ক্রেমাস্টা লেক (গ্রিস), গ্র্যান্ড ভেল লেক, (ফ্রান্স), লেক মিয়াড (যুক্তরাষ্ট্র), কার্ভিরা লেক (রোডেসিয়া-জিম্বাবুয়ে) ইত্যাদি এসব অঞ্চলে এ রকম ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও আগ্নেয়গিরির উৎপত্তির ফলে চুনাপাথরে দ্রবণ ক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট গহ্বরে স্তর পতনের ফলে ভূমিকম্পের উৎপত্তির সম্ভাবনা থাকে। অগ্ন্যুৎপাতের সঙ্গে ভূমিকম্পের সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জসহ ফিলিপাইনস অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
১৮৮৩ সালে জাভার ক্রকাটোয়ায় অগ্ন্যুৎপাতের সঙ্গে ঘন ঘন ভূকম্পন হয়েছিল তবে বেশিরভাগ ভূমিকম্পের মুখ্য কারণ যে ভূ-অভ্যন্তরের সংঘটিত ক্রিয়াকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সে কথা আজ প্রায় সুনিশ্চিত।১৯০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে সংঘটিত প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পর বিজ্ঞানী মিঃ এইচএফ রিড শিলাস্তরের স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেন, যখন শিলাস্তরের নিজস্ব প্রতিরোধী ক্ষমতার ওপর অধিক চাপ সৃষ্টি হয় তখনই সে শিলাস্তর সঞ্চিত চাপমুক্ত করতে শিলাচ্যুতির মাধ্যমে ভূ-আন্দোলনের সৃষ্টি হয় এবং তখনই ভূমিকম্পের উৎপত্তি ঘটে। এভাবে ভূস্তরে ঘটা বিচ্যুতির জন্যই ক’বছর আগে ভারতের গুজরাটে প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হয় বলে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন।
ভূমিকম্প উৎপত্তির কারণ অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা সক্ষমতা লাভ করেছেন এবং সে সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত ভূমিকম্প মাপক যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র নির্ণয় সম্ভবপর হয়ে উঠেছে এবং এর দ্বারা সম্ভাব্য ভূমিকম্পের স্থল বা বলয় চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ভূকম্পের এ বলয় পৃথিবীতে দুটো অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে আছে যেমন- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পূর্ব উপকূলের রকি, অ্যান্ড্রিজ ইত্যাদি পর্বত শ্রেণী অঞ্চল এবং পশ্চিম উপকূলের জাপান, ফিলিপাইন ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জ, কেরিবিয়ান উপকূল, নিউগিনি, নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ কুমেরু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে, ভূমধ্যসাগরের চারদিকে আল্পস, ককেসাস ইত্যাদি পর্বতের আশপাশে, হিমালয় পর্বতমালার চারপাশ, মায়ানমার, নেপাল, আসামসহ কাশ্মীর ও পশ্চিম ভারত এবং পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এ বলয়ের অন্তর্ভুক্ত। ভূ-তাত্ত্বিকরা ভূমিকম্পের আন্তর্জাতিক বলয়ের ও ভূমিকম্পের প্রাবল্যের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের পাঁচটি ম-ল বিভক্ত করেছেন। যেমন-জম্মু কাশ্মীরের এক বৃহৎ অংশ, হিমাচল প্রদেশসহ মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের একাংশ, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম পাহাড়ি অঞ্চল, বিহার, সিকিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহ এবং আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং বাংলাদেশ। এমনকি ভূমিকম্পের সম্ভাব্য স্থান নির্ণয়ে বিজ্ঞানীরা সক্ষম হলেও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস প্রদান ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণে এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হননি। ১৯৬০ সালে গামবেল নামের জনৈক বিজ্ঞানী একটা নতুন পরিসংখ্যান তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন এবং তাতে দেখা যায় বৃহৎ ভূমিকম্পের সংখ্যা ক্ষুদ্র ভূমিকম্পের চেয়ে অনেক কম। গুটেনবার্গ নামের একজন বিজ্ঞানী ভূমিকম্পের সংখ্যা এবং রিখটার স্কেলে দেখা ভূমিকম্পের মাত্রার মধ্যে একটা সমীকরণ উদ্ভাবন করেন যার দ্বারা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া কিছুটা সম্ভবপর হয়।
ভূমিকম্প শব্দটি দ্বারা যে কোনো প্রকার ভূকম্পনজনিত ঘটনাকে বোঝায় সেটা প্রাকৃতিক অথবা মনুষ্য সৃষ্ট যাই হোক না কেন। বেশিরভাগ ভূমিকম্পের কারণ হলো ভূগর্ভে ফাটল ও স্তরচ্যুতি হওয়া; কিন্তু সেটা অন্যান্য কারণ যেমন অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস, খনিতে বিস্ফোরণ বা ভূগর্ভস্থ নিউক্লিয়ার গবেষণায় ঘটানো আণবিক পরীক্ষা থেকেও হতে পারে। ভূমিকম্পের প্রাথমিক ফাটলকে বলে ফোকাস বা হাইপোসেন্টার। ভূঅভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূপৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এই রূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনই ভূমিকম্প। ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে ১/২ মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝেমধ্যে কম্পন এত দুর্বল হয় যে, তা অনুভব করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালী ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে।
এই কম্পনই ভূমিকম্প রূপে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়। কখনও কখনও আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও গলিত লাভা উৎক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। কখনও পাহাড় কিংবা উঁচু স্থান থেকে বৃহৎ পরিসরে শিলাচ্যুতিজনিত কারণে ভূমিকম্প হতে পারে। ভূত্বক তাপ বিকিরণ করে সংকুচিত হয়ে পড়লে ফাটল ও ভাঁজের সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্প হয়। ভূগর্ভে বাষ্প ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে তা ভূত্বকের নিম্নভাগ ধাক্কা দেয় ফলে প্রচ- ভূকম্পন অনুভূত হয়। কখনও প্রকা- হিমবাহ পর্বতগাত্র হতে হঠাৎ নিচে পতিত হয়েও ভূমিকম্প হয়।
বাংলাদেশ ভারত ও মায়ানমারের ভূঅভ্যন্তরের দুটি ভূচ্যুতির প্রভাবে আন্দোলিত হয়। বাংলাদেশ, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মায়ানমারের টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি দীর্ঘদিন যাবৎ হিমালয়ের পাদদেশে আটকে পড়ে আছে এবং অপেক্ষা করছে বড় ধরনের ভূকম্পনের। বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে, যথা: বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকু- টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির এলাকা, ডাওকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেমন্ট-ডোহের্টি আর্থ অবজারভেটরির ভূতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নিচে জমে ওঠা টেকটনিক প্লেটে চাপ জমে উঠছে কম করে বিগত ৪০০ বছর ধরে। এই চাপ যখন মুক্ত হবে, তখন সৃষ্ট ভূমিকম্পের মাত্রা দাঁড়াবে প্রায় ৮.২ রিখটার, এমনকি তা ৯ রিখটারেও পৌঁছতে পারে। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে হয় ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্প। এমনকি বুয়েটের মানমন্দিরে ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ৪ বছরে রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রার ৮৬টি ভূকম্পন নথিভুক্ত করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ৫ মাত্রার চারটি ভূকম্পনও ধরা পড়ে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের মানমন্দিরে ২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত কমপক্ষে ৯০টি ভূকম্পন নথিভুক্ত করা হয়, তন্মধ্যে ৯টিরই রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫-এর উপরে এবং সেগুলোর ৯৫ শতাংশ-এরই উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা শহরের ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে।
অতীতের এসব রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ভূমিকম্পের মাত্রা না বাড়লেও ১৯৬০ সালের পর থেকে ভূমিকম্প সংঘটনের হার বেড়েছে, অর্থাৎ ঘন ঘন স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। মতবিরোধ থাকলেও অনেক ভূতাত্ত্বিক ছোট ছোট ভূমিকম্প সংঘটন বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে উল্লেখ করেন। অতীতের এসব রেকর্ডকে প্রাধান্য দিয়ে গবেষকরা জানিয়েছেন যে কোনও সময় বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। সরকারি তথ্যসূত্র মতে, ঢাকায় রাতের বেলায় ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে লক্ষাধিক লোক হতাহত হবে। দিনের বেলায় হলে হতাহতের সংখ্যা হবে কিছুটা কম। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলের ৩,২৬,০০০ ভবনের উপর পরিচালিত সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, এমন তীব্রতার ভূমিকম্পে প্রায় ৭২,০০০ ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে, আরও ৮৫,০০০ ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু দালান ভাঙার কারণে ক্ষয়ক্ষতি হবে ৬-১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য সম্পদ। এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অফ আরবান এরিয়াস এগেইন্সট সিসেমিক ডিযাস্টার জরিপে ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম। যদিও ভূমিকম্পের সময় সুরক্ষার কোনও গ্যারান্টি নেই, আগাম পরিকল্পনার িেসথ সম্ভাব্য বিপদগুলো চিহ্নিতকরণ জীবন বাঁচাতে পারে এবং আঘাত ও সম্পত্তির ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে। উল্লেখ্য, সিলেটে পরপর পাঁচ বার মৃদু ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এদিন দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে পঞ্চম বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর আগে সকাল ১০টা ৩৭ মিনিটে প্রথম, ১০টা ৫১ মিনিটে দ্বিতীয়, বেলা ১১টা ২৯ মিনিটে তৃতীয় ও ১১টা ৪০ মিনিটে চতুর্থ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এরপর রোববার আবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভোর ৪টা ৩৫ মিনিটে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এই চার দফা ভূমিকম্প ছাড়াও এগুলোর আফটার শক হিসেবে আরও কয়েক বার সিলেটে কম্পন অনুভূত হয়েছে বলেও জানা গেছে। ভূমিকম্পগুলোর উৎপত্তিস্থল জৈন্তাপুর উপজেলার সারি নদীর উজানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে, যা ডাউকি ফল্ট লাইনের পূর্বপ্রান্ত। ডাউকি ফল্ট লাইন বা ফাটল রেখার অবস্থান সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের উত্তরে সীমান্তজুড়ে যা ভারতের শিলং মালভূমি এর দক্ষিণ সীমানা। ১৮৯৭ সালে ডাউকি ফল্ট লাইনে ৮ মাত্রারও বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হয়, যার তীব্রতা কলকাতা ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে এবং মিয়ানমার পর্যন্ত অনুভূত হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, পললভূমির নিচে অবস্থিত টেকটোনিক প্লেটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে থাকে। ভূত্বকের নিচের অবস্থা জানতে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূপদার্থবিদ মাইকেল স্টেকলারের নেতৃত্বে গবেষক দল বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অতি সংবেদনশীল বেশ কিছু জিপিএস যন্ত্র স্থাপন করে। ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকও অংশ নেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারেও এ রকম কিছু যন্ত্র বসিয়ে সমগ্র ফল্ট অঞ্চলের একটি মানচিত্র তৈরি করা হয়। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমসের (জিপিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি টেকটোনিক প্লেট আরেকটির নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর সেগুলোর অবস্থান বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও পূর্ব ভারতজুড়ে বিস্তৃত একটি অঞ্চলের নিচে। ফল্টের ওপরের স্তরে দুটি প্লেট পরস্পর লেগে আছে। এতে সৃষ্ট চাপের প্রভাবে প্রচ- শক্তিশালী ভূকম্পন হতে পারে। স্টেকলার বলেন, বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে নানা সমস্যা ধরা পড়েছে। সেখানে বালু ভরাট করে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করতেও দেখা যায়। ভূমিকম্প হলে এ রকম ভবন সহজেই ধসে পড়বে। এ ছাড়া অতিরিক্ত জনবহুল হওয়ায় সেখানে ভূমিকম্প হলে প্রাথমিক উদ্ধার তৎপরতায় বিঘ্ন হতে পারে। এখন স্বাভাবিক অবস্থায়ই ঢাকা শহরে যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানকার রাস্তায় যদি ভূমিকম্পের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো এবং উদ্ধার তৎপরতা চালানো সত্যিই অসম্ভব কাজ হবে। তবে এই ভূমিকম্প ঠিক কখন হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটা আগামীকালই হতে পারে, আবার ৫০০ বছর পরেও হতে পারে। গবেষণাপত্রটি আরও বলছে, অনিয়ন্ত্রিত ভবন ছাড়াও ভূমিকম্পে ভারী শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হতে পারে। ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কায় অযথা আতঙ্কিত না হয়ে যাতে ভূমিকম্পের পরবর্তী দুর্যোগের মোকাবিলায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন। বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। জেলা প্রশাসন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিধি বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা এবং ভূমিকম্প ডিজাইন না থাকা ঘরবাড়িগুলো শনাক্ত করে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করাও উচিত।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স