ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ও সংকট মোকাবিলা

সাধন সরকার »

বিশে^র সর্ববৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশে সাধারণত নতুন বাংলা বছর শুরু হয় বৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ বছরটা যেন একটু ব্যতিক্রম! এমনিতেই করোনা মহামারির কারণে জনজীবনে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। তার ওপর তীব্র দাবদাহে জীবনযাত্রা অতিষ্ঠ। অনেক দিন পর বিভিন্নস্থানে বিক্ষিপ্তভাবে মাঝেমধ্যে খুব অল্প পরিমাণ বৃষ্টির দেখা মিলছে। পানিচক্রের স্বাভাবিকতা ওলটপালট হয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। দেশজুড়ে পানির জন্য হাহাকার চলছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ।
বরিশাল বিভাগের জেলাসমূহে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে ডায়রিয়া ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পানি সংকটে লবণাক্ত দক্ষিণাঞ্চল আরো বেশি মাত্রায় লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশের সবখানে অনাবৃষ্টির প্রভাব পড়েছে। বহু স্থানে হস্তচালিত নলকূপ দিয়ে পানি ওঠছে না। গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তোলা গেলেও তাতেও সামগ্রিকভাবে পানির চাহিদা মিটছে না। সবচেয়ে বেশি পানি সংকটে ভুগছে গরিব ও অসচেতন মানুষেরা। নিরুপায় হয়ে বহু মানুষ খাল-পুকুরের দূষিত ও লবণাক্ত পানি ব্যবহার করে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
কেননা বাস্তবতা এটাই যে, অন্যসব না খেয়ে থাকা গেলেও পানি না খেয়ে জীবন ধারণ করা অসম্ভব। দেশের খাল-বিল, নদী-নালা জলাশয়গুলো দিন দিন বিপন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রাকৃতিক অনেক জলাশয়গুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কারণে পানি ধারণ ক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। তীব্র দাবদাহে পানি সংকটের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের পুকুর-খাল-নদনদীর পানি অনেক বেশি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। গরিব-অসহায় পরিবারগুলোকে বিশুদ্ধ পানির জন্য অনেক বেশি অর্থ, শ্রম ও সময় নষ্ট করতে হচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদের অনেক স্থানে এক কলস পানির জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে পানির সন্ধান করতে হচ্ছে। প্রান্তিক অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসিয়ে কিংবা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে। ঢাকাসহ জনবহুল স্থানসমূহে ভূগর্ভ থেকে মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর প্রতিবছর একটু একটু করে নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি সংকটে সেচকাজ ব্যাহত হচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে হাজার হাজার নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তথ্য মতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে পানির স্তর প্রতিবছর ৩ থেকে ৫ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। সেচ কাজের জন্য মাত্রাতারিক্ত পানি তোলার কারণে সেখানে প্রতিবছর পানির স্তর ২ থেকে ৩ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র এলাকায় সেচ কাজের জন্য খাল খনন করলেও খালও পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। গত দুই থেকে তিন দশক আগে বরেন্দ্র অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট নিচে পানি পাওয়া যেত। আর এখন পানির স্তর সেখানে ১৫০ ফুটের বেশি নিচে নেমে গেছে। গভীর নলকূপ বসিয়েও বরেন্দ্রভূমিতে প্রয়োজনের মাত্র অর্ধেক পানি পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রামে পানির স্তর অতিমাত্রায় নিচে নেমে গেছে। অনেক সময় গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তোলার ফলে ভূগর্ভের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার প্রমাণ মিলছে। ঢাকা শহরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে সবচেয়ে বেশি। কেননা নগরবাসীর প্রয়োজনের ৭০ ভাগই এখনো ভূগর্ভস্থ পানি। ঢাকা শহরের আশপাশের নদনদীর পানিও আগের চেয়ে অনেক বেশি দূষিত। ফলে নদ-নদীর পানি পরিশোধন করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে। নদ-নদীর দূষিত পানি বছরের পর বছর ভূগর্ভে প্রবেশ করলে তা একটা সময় ভূগর্ভের পানিকেও দূষিত করে ফেলবে। বাস্তবতা বলছে, ভূ-উপরিস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো ছাড়া সমস্যার সমাধান মিলবে বলে মনে হয় না।
সার্বিকভাবে পুরো দেশের চিত্র বলছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর একটু একটু করে নিচে নেমে যাচ্ছে।
রাজধানী ও বিভাগীয় বড় শহরগুলোতে নগরবাসীর পানির চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষিকাজেও পানির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভের পানি তুলতে তুলতে ফলশ্রুতিতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর যদি একটু একটু করে নিচে নেমে যেতে থাকে একটা সময় গিয়ে ভূগর্ভ থেকে আর পানি ওঠবে না। তাই ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। নাসার এক গবেষণা বলছে, পৃথিবীর ভূগর্ভে পানির যত মজুদ আছে তার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের কর্মকা-ের ফলে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। নাসার মতে, পৃথিবীর ভূগর্ভের ৩৭টি বৃহৎ পানি স্তরের মধ্যে ২১টির পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১৩টি স্তর প্রায় শুকিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেচকাজে প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়ার অন্যতম কারণ উজানে ফারাক্কার পানি প্রত্যাহার। ফলে শুকনো মৌসুমে নদ-নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। একতরফাভাবে ফারাক্কার পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করছে। শুকনো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হলে নদনদীর দূষণ বন্ধ করে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। সব ধরনের জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। যাতে শুকনো মৌসুমেও জলাশয়ের পানি সেচকাজে ব্যবহার করা যায়। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে। নগরের বাসাবাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে প্রয়োজনের সময় তা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যায়।

লেখক : কলামিস্ট, পরিবেশকর্মী
ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স