জাহিদ হাসান হৃদয়, আনোয়ারা »
১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল বাংলাদেশে দক্ষিণপূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০কিমি/ঘণ্টা বেগে আঘাত হেনেছিলো প্রলয়ংকরী ঝড়। সেই ঝড়ে ল-ভ- হয়ে যায় চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল। প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। আনোয়ারার উপকূলীয় এলাকার প্রতিটি ঘরেই রয়েছে এই ঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা। আজও উপকূলবাসী এইদিনটির কথা মনে পড়লে ভয়ে আঁতকে ওঠে।
সেদিনের সেই ভয়াবহ রাতের কথা স্মরণ করে আনোয়ারা উপজেলার উপকূলীয় রায়পুর ইউনিয়নের জহুরলাল শীল (৬৫) বলেন, ‘বৈশাখের ঝাঁঝালো রোদে চাষের জমি ফেটে গেছে। চারিদিকে বোরো ধান গোলায় তোলার ব্যস্ততা। এরই মাঝে খবর এলো উপকূলের দিকে ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। সাথে আসছে পানি। সবাই মনে করলো এই আর তেমন কি, পানি আসলে তা জমি খেয়ে ফেলবে। বিকেল থেকেই বাতাস বইতে শুরু করলো। রাতে হঠাৎ চলে আসলো পানি। চারিদিকে হু হু শব্দ। পানি, ঝড়, বৃষ্টি আর মানুষের কান্না-চিৎকারের শব্দ। সব মিলিয়ে সেই বিভীষিকাময় অবস্থা। নিমিষেই ঘরবাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যায়। দক্ষিণ দিক থেকে ভেসে আসতে শুরু করলো একের পর এক লাশ। আমাদের পাড়ায় একটায় দালানঘর ছিলো। সবাই ওখানে অবস্থান করলাম। হঠাৎ মনে পড়ে সত্তরোর্ধ জ্যাঠা-জেঠির কথা। পানির ভেতর ছুটে গেলাম জ্যাঠা-জেটির কাছে। দেখলাম ঘরের টুনি ধরে বসে আছে বৃদ্ধা জ্যাঠা-জেটি। জ্যাঠা অসুস্থ ছিলো, চলতে অক্ষম। জেটিকে বললাম আপনি চলে আসুন আমার সাথে কিন্তু জেটি উত্তর দিলো ‘মইরল্লে একহঙ্গে মইরগুম, বাচিলে একহঙ্গে বাইচ্চুম’। (মরলে একসাথে মরবো, বাঁচলে একসাথে বাঁচবো।) পরে নিজের জান বাঁচিয়ে চলে এলাম। পরবর্তীতে ২দিন পর আবু সৈয়দ চেয়ারম্যানের নতুন বাড়িতে (বর্তমান নাম) আমার জ্যাঠার লাশ খুঁজে পাই। কিন্তু জেটির লাশ আর খুঁজে পাইনি।
তিনি আরো জানান, সেদিন চোখের সামনে অনেক মানুষকে ভেসে যেতে দেখেছি। পানি চলে যাওয়ার পর তাদের লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে বিভিন্ন জায়গায় ; আবার অনেকেই হারিয়ে গেছেন চিরতরে।
১৯৯১ সালের ২২ এপ্রিল মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নি¤œচাপের সৃষ্টি হয়। ২৪ এপ্রিল নি¤œচাপটি ০২বি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসর হওয়ার সময় এটি আরও শক্তিশালী হয়। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং এর গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় ১৬০ মাইলে। ২৯ এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঘণ্টায় ১৫৫ মাইল বেগে আঘাত করে। স্থলভাগে আক্রমণের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং ৩০ এপ্রিল এটি চলে যায়। এই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের ১৯টি জেলার ১০২টি উপজেলা। তবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, খেপুপাড়া, ভোলা, টেকনাফ।
বর্তমান এবং তখনকার উপকূলীয় পরিস্থিতি নিয়ে আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। তখন উপকূলে সুরক্ষিত বেড়িবাঁধ ছিলোনা। এখন উপকূলের চারপাশে শক্তিশালী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্মাণ করা হয়েছে সাইক্লোন সেন্টার। আগের তুলনায় ঝড়ের সতর্ক সংকেত উপকূলের মানুষের কাছে আরো কার্যকরীভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সাথে ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরিয়ে আনার পদ্ধতিও বেশ জোরদার হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহয়তা বৃদ্ধি করেছে সরকার। তা-ই এখন ঘূর্ণিঝড় হলেও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমে আসবে।’