ড. আনোয়ারা আলম »
মহান বিজয় দিবস পালিত হলেও এখনো রয়ে গেছে উৎসবের আমেজ। এটাই স্বাভাবিক। কারণ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এই অর্জন। এ মাস এলেই স্মৃতিগুলো কথা বলে। ফিরে ফিরে যাই সেই ১৯৭১ সালের বিজয়ের মাসে। ব্যক্তিজীবনের এক গভীর অনিশ্চয়তা, তবুও ভুলে গোছি। জামাল খাঁনের পিডিবি কলোনির বাবার বাসার ছাদে হাতে বানানো পতাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছি। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। তবে একসময়ে সব যখন কিছুটা থিতু, তখন প্রিয়জন হারানোর সংবাদ। রাজনীতি করতাম তাই শুনি রব ভাই শহীদ বা অন্য কেউ। বন্ধুদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধ শেষে সেনাবাহিনীতে। হঠাৎ শুনি এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর মৃত্যুসংবাদ। ওর বাসায় গেলাম, কিন্তু খালাম্মা বা খালু একবারও উচ্চারণ করলেন না ওর কথা। জিজ্ঞেস করার সাহসও হলো না। পরে শুনি ও আত্মহত্যা করেছিল সাথে কিছু ইতি-উতি গল্প। এরপরে উঠে আসে বীরাঙ্গনার কথা পাকসেনাদর অত্যাচার ও নির্যাতনের ইতিহাস। এরই মাঝে কিছু চটি বই বাজারে। বীরাঙ্গনাদের উপর পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের গল্প। হায়! পর্ণো কাহিনীকে হার মানায়। বীরাঙ্গনারা হয়ে গেল মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার। কি কষ্ট। কি কষ্ট।
তখন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রও নির্মিত হচ্ছে। আমরা হলে। নারী মুক্তিযোদ্ধা একজনও নেই। শুধু ওদের ধরে নিয়ে যাওয়া বা ক্যাম্প থেকে মুক্ত করার দৃশ্য। এক ছকে বন্দি হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের ইতিহাস। অথচ বিভিন্ন আন্দোলনে যেমন তেমনি প্রস্তুতি কাল থেকে নারীরা ছিলেন সক্রিয়। ২৫ মার্চের কালো রাতে রওশন আারা বুকে মাইন বেঁধে ঝাপিয়ে পড়লেন ট্যাংকের সামনে। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল গ্রন্থে তিনি নিহত রওশন আরা শহীদ নন।
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের যে বহুমুখী অবদান ছিল তা ইতিহাসের পাতায় প্রথম দিকে একেবারেই উপেক্ষিত। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন দুজন একজন ক্যাপ্টেন সিতারা আরেকজন অন্যজন যুদ্ধের জন্য তিনি তারামন বিবি। তিনি এ খবর জানতেনও না। তখন তিনি ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ছাব্বিশ বছর পরে তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল। তিনি বীরপ্রতীক তারামন বিবি।হায়! নারী!
পঁচিশে মার্চের পর থেকে নারীরা অসংগঠিত ছিলেন ধীরে ধীরে গঠিত হলো গোবরা ক্যাম্প, নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ। এরপরে যুক্ত হতে থাকেন অনেক নারী। শিরিন বানু,মনিকা মতিন, ফেরদৌস আরা ডলি, কাঁকন বিবি, হালিমা খাতুন, মীরা ,ফোরকনা বেগম, শিরিন বানু বিমলাজি, দুখুমৎ বিবিসহ অনেক নাম না-জানা নারী। মেজর জলিলের অধীনে গঠিত হয়েছিল নারী বাহিনী। কিন্তু বিজয়ের পরে এরা ছিলেন অনেকে পর্দার অন্তরালে। যখন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধারা সবাই বীর দর্পে অস্ত্র হাতে তখন তাঁরা অন্তরালে এবং সমাজচক্ষুর ভয়ে।
এছাড়া শব্দ সৈনিক হিসেবে অনেক অনেক নারী, কেউ কণ্ঠে গান নিয়ে, বিভিন্ন ক্যাম্পে কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কথক হিসেবে কেউ আহতদের সেবায়। অর্থাৎ নারীর অবদান ছিল বহুমুখী।
আর বীরাঙ্গনাদের কথা বলতেই হয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু তাঁদের কাছে টেনে নেন। তাঁদের পুনর্বাসনে গণবিবাহে বা যুদ্ধ শিশুদের কারণে প্রবর্তিত দত্তক আইনের বিষয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। কিন্তু পরম বেদনার বিষয় শুধুমাত্র এই বিষয়টিই মূখ্য বিষয় হয়ে গেল।
বুদ্ধিজীবি হত্যা দিবসের কথা বলি এক্ষেত্রে কবি মেহেরুন্নেসাকে প্রথম হত্যা করা হয়। কারণ তিনি স্বাধীনতার পতাকা তুলেছিলেন দুইভাইকে নিয়ে।
বিজয় দিবসের এ মাসে এই দুঃখ ও বেদনার কথাগুলো বলতে হচ্ছে মনের বেদনায়। আশা করি ইতিহাসের পাতায় উঠে আসুক নারীর অবদানের কথা
আর আবারও বলি বীরাঙ্গনারা এখন শুধু সম্ভ্রম হারানো ওনারা এখন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের ব্যাপারে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বলা হোক সম্মানের সাথে। আবারও শ্রদ্ধার সাথে সবাইকে স্মরণ করছি।