সুপ্রভাত ডেস্ক »
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরের আগে ১৫টি লক্ষ্য ধরে ইন্দো-প্যাসিফিক ‘রূপরেখা’ ঘোষণা করেছে সরকার; যেখানে গঠনমূলক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং আলোচনার উপর গুরুত্বারোপ করে তা বাংলাদেশের টেকসই অর্থনীতি ও সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে বলে লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ত্রিদেশীয় সফর নিয়ে গণমাধ্যমকে জানানোর পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণার এ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরিন উপস্থিত ছিলেন।
চার মৌলিক নীতিমালার আলোকে ১৫টি লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা এবং এ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালিত করবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
সোমবার প্রধানমন্ত্রীর তিন দেশ সফরের বিষয়ে জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রূপরেখাটি তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেছেন, এ অঞ্চলের সব দেশের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ একটি অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক এর ধারণা বাস্তবায়নের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।
ভারত ও প্রশান্ত সাগরাঞ্চলকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছর ধরে আলোচিত এ কৌশলে অংশ নেওয়া নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন দেশ ও জোট। দেশগুলোর অর্থনীতি, বাণিজ্য ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তারা এতে অংশীদার হওয়ার কথা বলে আসছে।
আলোচনায় আছে চীনের আধিপত্য ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি-আইপিএস) তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। জো বাইডেন সরকার গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওই কৌশলে পরিবর্তনও আনা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের পথ ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপানসহ বিভিন্ন দেশ এর আগে তাদের কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে।
নিজেদের অবস্থান থেকে এই কৌশলপত্র প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হলেও এই অঞ্চলের দেশগুলোকে ওই কৌশলের সঙ্গে সম্পর্ক করার চেষ্টা আছে সেসব দেশ ও জোটের।
যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই চায় বাংলাদেশ অন্যান্য আঞ্চলিক দেশের মতো এ কৌশলগত জোটে অংশ নিক। এ ব্যাপারে ২০১৮ সাল থেকেই দেশটি আহ্বান জানিয়ে আসছে।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশকে টানতে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানসহ বিভিন্ন দেশের প্রচেষ্টা এর আগে দেখা গেলেও সরকার স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।
সরকার এতদিন বলে আসছিল, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আগ্রহ থাকলেও সামরিক কোনো পদক্ষেপে বাংলাদেশ ‘আগ্রহী নয়’।
তবে ২৫ এপ্রিল জাপান যাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ১৫ দিনের লম্বা সফরের আগে এ বিষয়ে রূপরেখার কথা জানাল বাংলাদেশ সরকার। জাপান থেকে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাবেন এবং সেখান থেকে দেশে ফেরার পথে যুক্তরাজ্যে একটি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর ফিরবেন ৯ মে।
ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণা করতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার বলেন, “আপনারা অনেকদিন থেকে প্রশ্নটি অনেকবার করেছেন এবং কথাবার্তা হয় বিষয়টি নিয়ে, সেটি হলো ইন্দো-প্যাসিফিকে বাংলাদেশের অবস্থান।
“আমরা বাংলাদেশের তরফ থেকে একটা ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা বা আউটলুক চূড়ান্ত করেছি। এ বিষয়ে আপনাদেরকে অবহিত করতে চাই।”
রূপরেখার ভূমিকায় তিনি বলেন, “বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিকে তার ‘ভিশন ২০৪১’ বাস্তবায়ন তথা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি আধুনিক, জ্ঞানভিত্তিক, উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করে।
“ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বৈশ্বিক জিডিপিতে সামষ্টিক অংশ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অগ্রগণ্য অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সামগ্রিক কার্যক্রম এবং প্রযুক্তি খাতে গতিশীল বিকাশ বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী টেকসই অর্থনীতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিতকল্পে একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করতে পারে।”
চার মৌলিক নীতিমালা
♦ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্র নীতির মূলমন্ত্র ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’।
♦ বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলনীতিসমূহ, যথা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা; আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য অবিরাম প্রয়াস অব্যাহত রাখা।
♦ সমুদ্র আইন সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ বা আনক্লস, ১৯৮২-সহ প্রযোজ্য জাতিসংঘ চুক্তিসমূহ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক কনভেনশনসমূহ মেনে চলা।
♦ টেকসই উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, মানবিক কার্যক্রম এবং মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে গঠনমূলক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা।
অভিষ্ট লক্ষ্য ১৫
চার মৌলিক নীতিমালার আলোকে ১৫টি লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা এবং এ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমকে পরিচালিত করবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার।
♦ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সকলের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখা, অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ এবং সংলাপ ও বোঝাপড়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করা।
♦ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের মেরিটাইম বিষয়ক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিদ্যমান কাঠামোকে শক্তিশালীকরণ, যথা সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়া ও সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আনক্লস, ১৯৮২-সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন অনুসারে অবাধ সামুদ্রিক চলাচল ও কোনো দেশের ভূখণ্ড বা জলসীমার উপর দিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিমান চলাচলের অধিকারের বিষয়ে পূর্ণ সমর্থন বজায় রাখা।
♦ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট সহযোগীদের সঙ্গে একযোগে আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ, শান্তিরক্ষা, শান্তি বিনির্মাণ এবং সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে অর্থবহ ও আন্তর্জাতিক মূল্যবোধসম্পন্ন অবদান রাখা।
♦ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আন্তঃদেশীয় সংগঠিত অপরাধসমূহ দমনে নীতি কাঠামো প্রণয়ন ও ব্যবহারিক পদক্ষেপের মাধ্যমে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়াসকে সমর্থন করা।
♦ জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রবর্তিত ‘শান্তির সংস্কৃতি’ এজেন্ডা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা সম্প্রসারণ, ‘নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা’ এজেন্ডার উপর অব্যাহত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বজায় রাখা; আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
♦ উন্মুক্ত, স্বচ্ছ ও নিয়মভিত্তিক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাসমূহ সুসংহতকরণের মধ্য দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়নের অধিকার এবং সকলের সার্বিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক এবং এর বাইরেও সুষম ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখা।
♦ ভৌত, প্রাতিষ্ঠানিক, জ্বালানি, ডিজিটাল এবং মনুষ্য পর্যায়ে সংযুক্তির প্রসার, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পণ্য, পরিষেবা, পুঁজি এবং জনগণের চলাচল সহজতর করা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর, অভিগম্য উদ্ভাবন এবং উন্মুক্ত ও নিরাপদ সাইবারস্পেস ও মহাকাশে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
♦ যে কোনো ভবিষ্যৎ সঙ্কট ও বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতি সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন ও অবাধ বাণিজ্য প্রবাহকে সুসংহত করতে টেকসই আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক যোগান শৃঙ্খল বা ভ্যালু চেইন তৈরির উদ্দেশ্যে দেশীয় কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতসমূহের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা।
♦ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৪-সহ আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উন্নয়ন অঙ্গীকারসমূহের আলোকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মহাসাগর, সাগর এবং সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ, টেকসই ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনাকে সুসংহত করা।
♦ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা, জল-সংহতি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে দেশীয় উত্তম চর্চাসমূহকে তুলে ধরাসহ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা।
♦ জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, সামুদ্রিক দূষণ এবং পরিবেশের উপর ক্ষতিকারক প্রভাবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও অঙ্গীকারসমূহের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধারাবাহিকভাবে দৃশ্যমান কার্যক্রম গ্রহণ করা।
♦ সকলের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
♦ ভবিষ্যৎ অতিমারী মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা জোরদারকরণের লক্ষ্যে ভ্যাকসিন, ডায়াগনস্টিক ও চিকিৎসা সুরক্ষা সামগ্রীর মত ‘বৈশ্বিক সম্পদ’ এ সকলের অভিগম্যতা নিশ্চিত করাসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
♦ আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ এবং পরস্পরের পরিপূরক স্বার্থসমূহ সমুন্নত রাখতে উপ-আঞ্চলিক অংশীদার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সহযোগিতা জোরদার করা।
♦ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা এবং উদ্ভাবন খাতে সহযোগিতা ও সম্পৃক্তি বাড়ানোর মাধ্যমে সকলের সামষ্টিক কল্যাণ নিশ্চিতপূর্বক ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ রূপকল্প পূরণে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস অব্যাহত রাখা।
সূত্র : বিডি নিউজ