সুপ্রভাত ডেস্ক »
লঙ্কান পেসার মাথিশা পাথিরানাকে চার মেরে ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়ে আকাশের দিকে আঙুল তুলে সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বললেন জাকের আলী অনিক। হয়তো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন! অনেক সংগ্রাম, অনেক ত্যাগ স্বীকারের পর এই মঞ্চটা পেয়েছেন তিনি। এশিয়ান গেমসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হলেও জাতীয় দলের জার্সিতে হোম গ্রাউন্ডে ‘আসল’ শুরুটা হলো জাকেরের। অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলে লঙ্কানদের বিপক্ষে জয়টা ছিনিয়ে নিতে পারতেন। সেই পথেই ছিলেন। কিন্তু বড় শট খেলতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নিতেই ম্যাচটা হাত ফসকে যায়!
সিলেটে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে জাকের নামতেই গ্যালারিতে স্লোগান উঠে ‘জাকের..জাকের’। যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন, এই স্লোগানেই মাতোয়ারা ছিলেন দর্শকরা। জাকের আউট হতেই গ্যালারি যেন মৃত নগরীতে রূপ নেয়। শেষ তিন বলে প্রয়োজন ১০ রান। ক্রিজে ব্যাটিংয়ে নামেন শরিফুল। সবার মনে শঙ্কা পারবে তো বাংলাদেশ। শরিফুল ৪ দিয়ে শুরু করেন। পঞ্চম বলে সিঙ্গেল নিয়ে স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে দেন তিনি। শেষ বলের জন্য প্রস্তুত তাসকিন। কিন্তু তিনিও পারলেন না, সিঙ্গেল নিতেই জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে ওঠে শ্রীলঙ্কা উইন বাই থ্রি উইকেট!
বাংলাদেশের বোলারদের ছন্নছাড়া বোলিংয়ের সুযোগ নিয়ে শ্রীলঙ্কা ২০৬ রানের পাহাড় গড়ে ৩ উইকেটে। সেই পাহাড় টপকাতে দায়িত্বশীল ব্যাটিং করতে হতো টপ অর্ডারকে। কিন্তু পাওয়ার প্লের আগেই টপ অর্ডারের তিন ব্যাটারকে হারিয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকেই গিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথম ওভারেই বাজে শট খেলতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন লিটন, রানের খাতা না খুলেই। ব্যাটিংয়ে ব্যর্থ হওয়ার আগে কিপিংয়ে ক্যাচ ছেড়েছিলেন তিনি, তাতেই গ্যালারি থেকে শোনা যায় ‘ভুয়া ভুয়া’ চিৎকার। রানের খাতা না খুলে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথেও লিটনকে শুনতে হয় ‘ভুয়া..ভুয়া’। এরপর সৌম্য সরকার (১২) ও তাওহীদ হৃদয় (৮) দলীয় ৩০ রানে বিদায় নিলে প্রবল চাপে পড়ে যায় স্বাগতিকরা।
অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত ধীরস্থিরভাবে খেলে চাপ কমানোর চেষ্টা করছিলেন। তবে মাহমুদউল্লাহ শুরু থেকেই ছিলেন আক্রমণাত্মক, নেমেই ছক্কা মারেন। শান্তর সঙ্গে ২৮ বলে ৩৮ রানের জুটির পর জাকেরের সঙ্গে গড়েন ২৯ বলে ৪৭ রানের জুটি। অধিনায়ক শান্ত ২০ রান করে আউট হওয়ার পর জাকেরকে নিয়েই দলকে ম্যাচে ফেরান অভিজ্ঞ এই ব্যাটার।
মাহমুদউল্লাহ যখন ব্যাটিং করছিলেন, মনে হচ্ছিলো ম্যাচটা সহজেই জিতে যাবে বাংলাদেশ। বাহারি সব শটে ২৭ বলে সপ্তম হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন তিনি। মিড উইকেট দিয়ে বিশাল এক ছক্কায় বলও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ৩১ বলে ২ চার ও ৪ ছক্কায় ৫৪ রানের ইনিংস খেলে আউট হন মাহমুদউল্লাহ। তার এক একটি শট গ্যালারিতে আছড়ে পড়তেই গ্যালারি যেন টালমাটাল হয়ে উঠেছিল। ‘মাহমুদউল্লাহ-মাহমুদউল্লাহ’ স্লোগানে মুখরিত সিলেট স্টেডিয়ামের গ্যালারি।
মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে জুটি গড়া জাকের তখনও হাত খোলেননি। তবে সঙ্গী সাজঘরে যেতেই একের পর এক বাউন্ডারি মেরে আস্কিং রান রেট কমিয়ে ফেলছিলেন তিনি। শেষ দুই ওভারে বাংলাদেশের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ২৭ রান। পাথিরানার ছন্দহীন বোলিংয়ের সুযোগ নিয়ে জাকের ১৯তম ওভারে তুলে নেন ১৫ রান। তাতে করে জিততে বাংলাদেশের লাগতো ১২ রান। কিন্তু দাসুন শানাকার প্রথম বলে রিশাদ বিদায় নেন। একটি ওয়াইডের পর সিঙ্গেল নিয়ে জাকেরকে ব্যাটিং প্রান্তে পাঠান তাসকিন। ওভারের তৃতীয় বলে শানাকাকে লংঅন দিয়ে খেলতে চেয়েছিলেন জাকের। কিন্তু বলটাকে সীমানা ছাড়াতে পারলেন না। চারিথ আসালাঙ্কার হাতে তালুবন্দি হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় ঘরের ছেলেকে। জাকের থাকা অবস্থায় গ্যালারি ছিল উৎসবে মাতোয়ারা। জাকের আউট হতেই পুরো গ্যালারিতে পিনপতন নীরবতা!
এরপর শরিফুলের চারে দর্শকরা চেপে রাখা নিশ্বাসটুকু ছাড়ার সুযোগ পেলেন! শেষ দুই বলে ৬ রান দরকার। কিন্তু তাসকিন-শরিফুল কোনও বাউন্ডারি মারার সুযোগ না পাওয়াতে বাংলাদেশের ইনিংস থামে ২০৩ রানে। আর তাতেই ৩ রানের হারে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরু করে বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের চতুর্থ ম্যাচে খেলতে নেমেই ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেন জাকের, ২৫ বলে ১ চার ও ৬ ছয়ে ফিফটি করেন। ৩৪ বলে ৪ চার ও ৬ ছক্কায় ৬৮ রান করে থামেন।
লঙ্কান বোলারদের মধ্যে পাথিরানা ছিলেন ছন্দহীন। এই বোলারই বাংলাদেশি ব্যাটারদের বেশ সুযোগ দিয়েছেন। ৪ ওভারে ৫৬ রান খরচায় তার শিকার একটি উইকেট। সর্বোচ্চ দুটি করে উইকেট নিয়েছেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ, শানাকা ও বিনুরা ফার্নান্ডো।
এর আগে টস হেরে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছিলো শ্রীলঙ্কা। প্রথম ওভারেই আভিষ্কা ফার্নান্ডোকে তুলে নিয়ে দারুণ শুরু করেন শরিফুল ইসলাম। তার দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে লিটন দাসকে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন লঙ্কান এই ওপেনার। এরপর দ্রুতই দ্বিতীয় উইকেট তুলে নেয় বাংলাদেশ। তাসকিনের ব্যাক লেন্থের একটি বল মিডউইকেটে খেলতে গিয়ে সৌম্য সরকারের হাতে তালুবন্দি হন কামিন্দু মেন্ডিস। আউট হওয়ার আগে ১৪ বলে ১৯ রান করেন লঙ্কান এই ব্যাটার।
কিন্তু পাওয়ার প্লেতে লঙ্কানকে আটকে রাখতে পারলেও পরের সময়টাতে বাংলাদেশের বোলাররা যেন খেই হারিয়ে ফেলেন। তাসকিন-শরিফুল-মেহেদী-মোস্তাফিজদের বিপক্ষে তৃতীয় উইকেটে লঙ্কান দুই ব্যাটার কুশল মেন্ডিস ও সাদিরা সামারাবিক্রমা মিলে ৬১ বলে ৯৬ রানের জুটি গড়েন। লেগ স্পিনার রিশাদ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা কুশলকে ফেরান। ততক্ষণে অবশ্য ৩৬ বলে ৫৯ রানের ইনিংস খেলে দলের স্কোরকে দেড়শোর কাছাকাছি নিয়ে যান। ৬ চার ও ৩ ছক্কায় কুশল নিজের ইনিংসটি সাজান।
এরপর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক চারিথ আসালঙ্কাকে নিয়ে সামারাবিক্রমা ঝড়ো ব্যাটিং করেন। দুইজনের অবিচ্ছিন্ন ৩৩ বলে ৭৩ রানের জুটির ওপর দাঁড়িয়ে পাহাড়সম রান করে শ্রীলঙ্কা। ৪৮ বলে ৮ চার ও ১ ছক্কায় ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি (৬১) করেন এই সামারাবিক্রমা। আসালাঙ্কা ২১ বলে ৪৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন।
বোলিংয়ে বাংলাদেশের শুরুটা ভালো হলেও শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি কেউই। সবাই কম বেশি খরুচে বোলিং করেছেন। শরিফুল, তাসকিন ও রিশাদ প্রত্যেকে একটি করে উইকেট নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ৪৭ রান দেন শরিফুল, তারপর যথাক্রমে ৪২ ও ৪০ রান দেন মোস্তাফিজ ও তাসকিন।