♦ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ উদ্বোধন অক্টোবরে ♦ বড় আকারের ফিডার ভেসেল সরাসরি বাংলাদেশে আসতে পারবে ♦ দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হবে এ বন্দর
নিজাম সিদ্দিকী »
উদ্বোধন হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের অধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের কাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মাসে এ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন বলে কথা রয়েছে।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার গ্রামীণ জনপদ মাতারবাড়ি ইউনিয়ন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাকে বেগবান করতে মহেশখালী-মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে যে ৩৪টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এতে বদলে যাচ্ছে চিরচেনা মাতারবাড়ি। এখানে গড়ে উঠছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, কোল জেটি, এলএনজি টার্মিনালসহ বাণিজ্যিক বন্দর। এই বন্দরের পোতাশ্রয়ে ১৬ মিটার পর্যন্ত ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে সামগ্রিক পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে আনুমানিক ১৫ শতাংশ।
ভূ-অবস্থানগত সুবিধা এবং গভীর সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা থাকায় মাতারবাড়ি বন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হবে। এ বন্দরকে কেন্দ্র করে নিকটবর্তী এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের পাশাপাশি অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়ন ঘটবে। ফলে বিপুলভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ব্লু-ইকোনমি তথা তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। এতে দুই শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর
২০২০ সালের মার্চে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়। এর মধ্যে ১২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান। বাংলাদেশ সরকার ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা যোগান দেবে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের দুটি অংশ। একটি হলো বন্দর নির্মাণ এবং অপরটি সড়ক ও জনপথের আওতাধীন সড়ক নির্মাণ। প্রকল্পের আওতায় ৩০০ মিটার দীর্ঘ একটি মাল্টিপারপাস জেটি এবং ৪৬০ মিটার দীর্ঘ একটি কনটেইনার জেটি নির্মিত হবে। জেটি নির্মাণ কাজ শেষ করতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। তখন ১১ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বন্দর।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের দুই টার্মিনালে মোট ৭৬০ মিটার দীর্ঘ জেটি নির্মাণ করা হবে। সেখানে ৪৬০ মিটার দীর্ঘ জেটিতে ভিড়বে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার জাহাজ। আর ৩০০ মিটার দীর্ঘ জেটিতে ভিড়বে ২০০ মিটার লম্বা সাধারণ জাহাজ। নৌপথে এখন পানির গভীরতা ১৬ মিটার। এই গভীরতা ব্যবহার করে ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে চালু হবে জাহাজ থেকে কনটেইনার ও পণ্য ওঠানো নামানোর এই টার্মিনাল। ইতিমধ্যে প্রকল্পের আওতায় মাতারবাড়ি টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ও ১৬ মিটার (সিডিএল) গভীরতা সম্পন্ন ১৪ দশমিক ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এপ্রোচ চ্যানেল নির্মাণ শেষ হয়েছে। এছাড়াও এপ্রোচ চ্যানেলের উত্তর পাশে ২ হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ ও দক্ষিণ পাশে ৬৭০ মিটার দীর্ঘ ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ নিরোধক বাঁধ) নির্মাণের কাজও সম্পন্ন হয়েছে।
কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র
২০১৫ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করে সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত ১৪ দশমিক তিন কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ করা হয়।
কয়লা বিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরবর্তী সময়ে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের চওড়া ১০০ মিটার বাড়াানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়।
জানা গেছে, মাতারবাড়ি কয়লাবিদুৎ কে›ন্দ্র চালু হবে আগামী বছর। মাতারবাড়ি এখনো বন্দর হিসাবে গড়ে না উঠলেও এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লাবাহী ৭টি বড় জাহাজ ভিড়ে ইতিমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্য ও বন্দর ব্যবস্থাপনায় নিজেদের সক্ষমতার রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ।
এই গভীর সমুদ্রবন্দরের পাশেই ১২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ১৬ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়নোর জন্য এরই মধ্যে ১৪ দশমিক তিন কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল খনন করা হয়েছে।
এ বছরের ২৯ জুলাই দুপুর ১২ টায় কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। এদিন ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিটটি চালু করা হয়। এখানে প্রতিঘণ্টায় ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, যা জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হচ্ছে। বিদ্যুকেন্দ্রটির মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১২০০ মেগাওয়াট। পরীক্ষামূলক এই প্রক্রিয়া সফল হলে আগামী ডিসেম্বরই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোদমে চালু হবে।
মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নে ১ হাজার ৬০৮ একর জমির ওপর স্থাপিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা ‘জাইকার’ সহায়তায় প্রায় ৫১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে। ৭ বছর মেয়াদে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতা করছে জাপানের সুমিতোমো, তোশিবা ও আইএইচআই কোম্পানির কনসোর্টিয়াম। ২০১৭ সালে প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয়। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিএল) এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
সোনাদিয়া-পায়রা থেকে মাতারবাড়ি
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনায় কক্সবাজারের সোনাদিয়া, মাতারবাড়ি, আবার কখনো পটুয়াখালীর পায়রার নাম শোনা গিয়েছিল।
সোনাদিয়া ও পায়রা বাদ দিয়ে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি বড় কারণ হিসেবে জাইকার অর্থায়নে সেখানে চলমান কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে আরেকটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
জানা যায়, সোনাদিয়া থেকে সরে এসে পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের পর অনুধাবন করা হয় সেখানে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করলে তা দেশের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক হবে না। সেখানে চ্যানেলের ৭০ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করতে প্রতিবছর প্রচুর টাকা খরচ হবে। এসব কারণে জায়গাটিকে উপযুক্ত নয় বলে মনে করে সরকার। সে জন্যই পায়রার পরিবর্তে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
জাপানের নিপ্পন কোয়ে, জার্মানির পিচনার, জাপানের টেপসকো ও অস্ট্রেলিয়ার এসএমইসি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষার ভিত্তিতে গভীর সমুদ্রবন্দরের নতুন কাঠামো চূড়ান্ত করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে বিভিন্নদেশ থেকে আসা মাদার ভেসেল বা বড় জাহাজ সরাসরি বন্দরে ভেড়ানো যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে সর্বোচ্চ ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ ভেড়ার সুযোগ আছে। অন্যদিকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে সর্বোচ্চ এক লাখ মেট্রিক টনের বেশি পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়ার সক্ষমতা রয়েছে। তাছাড়া, বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য নিয়ে আসা এবং তা খালাস করতে তিন মাসের মতো সময় লেগে যায়। গভীর সমুদ্রবন্দর হলে পণ্য খালাসের এ সময় অনেক কমে আসবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কোনো চালান সরাসরি ইউরোপে যায় না। প্রথমে কার্গো কন্টেইনারগুলো সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো বন্দরে যায়। পরে সেখানে ইউরোপে যাওয়ার মতো কোনো মাদার ভেসেলের জন্য অপেক্ষা করে। এর ফলে সময় ও খরচ অনেক বেড়ে যায়। ২০২৬-এর জানুয়ারি মাসের মধ্যে মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরের শেষ কাজ হলে বড় আকারের ফিডার ভেসেল সরাসরি বাংলাদেশে আসতে পারবে।