বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

জ্যোর্তিময় আওয়ামী লীগ

প্রফেসর ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী »

আজ ২৩ জুন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার দিন। ১৯৪৯ সালের সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্ব-বাংলার রাজধানী ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের জন্ম। এই দলের সভাপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগের সাথে শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নামও গৌরবে উল্লেখযোগ্য।

আওয়ামী লীগ এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দলও বটে। আওয়ামী লীগের পূর্বে ব্রিটিশ ভারতের প্রাচীনতম দল জাতীয় কংগ্রেস ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দুই দশক পর ‘মুসলীম লীগের’ জন্ম ১৯০৬ সালে ঢাকার নওয়াবদের বিনোদন কেন্দ্র আজকের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ধারাবাহিক সংগ্রামের ফসল হিসেবে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ভারতের স্বাধীনতা ও বিভক্তি কিছুটা ব্রিটিশ শাসকদের ইচ্ছা, ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ফসল। আর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সমসাময়িক সংগ্রাম, মাওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের উৎকর্ষতায়। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি। ভারত-পাকিস্তান অর্জনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন হিন্দু-মুসলমান। আর ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে নিহত হন ৩০ লক্ষ বাঙালি আর সম্ভ্রম হারান লক্ষ লক্ষ কন্যা-জায়া-জননী।

ব্রিটিশ ভারতে কংগ্রেস, লীগের জন্ম ডিসেম্বরের শেষ দিনগুলোতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জন্ম ২৩ জুন। বাংলার ইতিহাসে ২৩ জুনের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় ঘটে এবং বাংলা-ভারতে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন হয়। বাঙালির জীবনে পলাশি ট্র্যাজেডি ঐতিহাসিক দিন।

আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নে বঙ্গবন্ধুÑ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ১৯৫৫ সালে সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৬৬ সাল থেকে মৃত্যু অবধি সভাপতি ছিলেন। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আল জিন্নাহ ও মহাত্মা গান্ধী মুসলিম লীগ-কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিন নেতাই স্ব-স্ব দেশে জাতির পিতার মর্যাদা পান।

পৃথিবীর ইতিহাসে জাতীয়বাদ ও গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশের অভ্যূদয় সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার অগ্রবর্তী দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখি কোনো কোনো দেশ আগে স্বাধীন হয়েছে পরে দলের সৃষ্টি হয়েছে। ভারত ছাড়াও ইংল্যান্ড ও আমেরিকা এর প্রকৃত উদাহারণ। রোমান সা¤্রাজ্য থেকে ইংল্যান্ড স্বাধীন হওয়ার প্রায় বারশত বছর পরে বর্তমান প্রাচীন রাজনৈতিক দল ‘কনজারভেটিভ পার্টির’ জন্ম ১৮৩৪ সালে যা ছিল ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দের ‘টরি’ আন্দোলনের ফসল। আর অন্যতম দল ‘লেবার পার্টির’ জন্ম ১৮৫৯ সালে। আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পঁচ দশক পর সেদেশের প্রধান-প্রথম দল ‘ডেমোক্রেটিক পার্টির’ জন্ম। আর ১৮৫৪ সালে অন্যতম দল ‘রিপাবলিকান পার্টির’ জন্ম। ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ভারতের উপর্যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো হয় স্বাধীনতা, নয়তো দেশ ও রাষ্ট্র গঠনে অদ্যাবধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৭৪ বছর হলো। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করছে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে দেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমানে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ১৪ বছরের অধিক। এর আগে বঙ্গবন্ধুর হাতে দু’দফায় ৭১-৭৫ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকেছে দলটি।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু। এই দলের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রাপ্তির বৈধতা লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত পোড়ামাটির দেশকে শুধু পুনর্গঠনই করেননি, অতি অল্প সময়ে বিশ^মানের একটি সংবিধান প্রণয়ন, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, দেশের সার্বভৌমত্ব অটুট রেখে দেশের মর্যাদা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর ছয় বছরে এই রাজনৈতিক দল কিছুটা বেপথু হয়ে যায়।

বিদেশে অবস্থান করায় ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকা- থেকে বেঁচে যাওয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা ভারতে থাকা অবস্থায় সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। একই বছরের ১৭ মে ভারত থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে (নির্বাচিত ভিপি, ইডনে গার্লস কলেজ) সম্পৃক্ত ছিলেন। পিতা-মাতা ও স্বজনহারা শেখ হাসিনা দৃঢ় মনোবল ও অসীম সাহসের সাথে ¤্রয়িমাণ আওয়ামী লীগকে জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় পুনরুজ্জীবন দান করেন। দলের সভাপতি ছাড়াও জাতীয় সংসদে ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৬ সালে দলের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয় লাভ করে রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জন করে। মাঝে একবার বিরতির পর ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ভারত, পাকিস্তান ছাড়াও বিশে^র গণতান্ত্রিক দেশগুলো যেমন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নানা সময় দেশ পরিচালনা করেছে তার চেয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকার দেশ ও জতির সেবা করার বিরল সম্মান অর্জন করেছে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করে চলেছে। করোনা অতিমারির রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-উইক্রেন যুদ্ধে বিশ^ এখন বেসামাল। শেখ হাসিনা এতদসত্ত্বেও তাঁর লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জন, বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নত করা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে চলেছেন। দেশের অর্র্থে পদ্মাসেতু নির্মাণ, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন শেখ হাসিনার সাফল্যগাথা। তিনি এখন বিশে^ নারী নেতৃত্বে তৃতীয় এবং এশিয়ার লোহমানবী। দলীয় সভাপতি হিসেবে ৪২ বছর নেতৃত্বে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দ্বি-বার্ষিক বা ত্রি-বার্ষিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ আশা করেন ২০৩১ সালে বাংলাদেশ উন্নত বিশে^র কাতারে প্রবেশ করবে এবং নেতৃত্বে থাকবে আওয়ামী লীগের সরকার। আওয়ামী লীগের সরকারই করবে স্মার্ট বাংলাদেশ। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

লেখক: সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ