প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাপানে উষ্ণ অভ্যর্থনা

সুপ্রভাত ডেস্ক »

দুই সপ্তাহে তিন দেশ সফরের শুরুতে জাপানে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; সেখানে তাকে দেওয়া হয়েছে লাল গালিচা সংবর্ধনা। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ভিভিআইপি ফ্লাইটটি জাপানের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে টোকিও’র হানেদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পৌঁছায়। খবর বিডিনিউজের।

বাসস জানায়, জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাকেই সানসুকে ও জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাহাবুদ্দিন আহমেদ বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান। সেখানে তাঁকে লাল গালিচা সংর্বধনা এবং গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।

বিমানবন্দর থেকে মোটর শোভাযাত্রা করে শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘আকাসাকা’ প্রাসাদে। টোকিও সফরে তিনি সেখানেই থাকবেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত টোকিও সফর করবেন। এই সফরে জাপানের সাথে স্বাক্ষরিত হবে আট চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক।

টোকিও থেকে ওয়াশিংটনে গিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্বের সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা। এরপর সেখান থেকে লন্ডনে রাজা চার্লসের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। সফর শেষে ৯ মে তাঁর দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

বুধবার বিকালে জাপানের সম্রাট নারুহিতোর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন প্রধানমন্ত্রী। সন্ধ্যায় জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেবেন তিনি। তাদের উপস্থিতিতে আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আয়োজিত নৈশভোজের মাধ্যমে শীর্ষ বৈঠকের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।

২৭ এপ্রিল টোকিওর একটি হোটেলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) আয়োজিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা।

ওইদিন চার জন জাপানি নাগরিককে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সম্মাননা’ তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী জাপান প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজনে এক নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেবেন।

জাপান সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী আরও কিছু দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশিমাসা হায়াশি, জাইকা, জেট্রো, জেবিক, জেবিপিএফএল, জেবিসিসিইসি’র নেতৃবৃন্দ, জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত শিনজো আবের সহধর্মিণী আকিয়ে আবে এবং জাপানের স্থপতি তাদাও আন্দো সাক্ষাৎ করবেন তাঁর সঙ্গে।
এছাড়া জাপানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

কেন গুরুত্বপূর্ণ জাপান সফর
এই তিন দেশের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর পাচ্ছে বাড়তি গুরুত্ব। সরকার আশা করছে, এ সফরে জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ পৌঁছানোর পথ তৈরি হবে।

এর আগে সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারপ্রধানের এই লম্বা সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

সেখানে মোমেন বলেছিলেন, ‘এই সফরে দুই দেশের মধ্যে যে আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে তার মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সইয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘প্রতিরক্ষা সংলাপ, দ্বিপক্ষীয় সফর, শিক্ষা, ট্রেইনিং কোর্স, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং দুইপক্ষের সম্মতিতে এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রসার ও শক্তিশালী করার জন্য” এই সমঝোতা হচ্ছে।

প্রতিরক্ষার ‍চুক্তির বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও শক্তিশালী করতে চাই, তারই অংশ হিসাবে এটা করা। এবং এটাতে অন্য কোনো উপাদান নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে এবং আমরা বিনিয়োগ করছি যেখানে সম্ভব হচ্ছে, সবক্ষেত্রেই। আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির বৃহত্তর কর্মসূচির অংশ হিসাবে এগুলো করা হচ্ছে।’

চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো কেবল দুদেশের সহযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে জানিয়ে শাহরিয়ার বলেন, এর বাইরে কোনো দেশ বা বহুপক্ষীয় উপাদান এর মধ্যে নেই।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বাইরে কৃষি, মেট্রোরেল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আপগ্রেডেশন, শিপ রিসাইক্লিং, কাস্টমস, মেধাস্বত্ব, আইসিটি এবং সাইবার সিকিউরিটি সহযোগিতা রয়েছে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের তালিকায়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘সার্বিক অংশীদারিত্বে’ উন্নীত হয়, যা বর্তমান বাংলাদেশ-জাপান বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।

‘দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তীতে শেখ হাসিনা ও ফুমিও কিশিদার বার্তায় দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিকট ভবিষ্যতে নতুন উচ্চতায় বা কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

‘এ সফর দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব সহকারে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করবে।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী, আইসিটি প্রতিমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল রয়েছেন জাপান সফরে।

এছাড়া প্রায় ৫০ জনের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল সফরের সময় জাপানে যাচ্ছে বলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন।

জাপান সফরের পর বাংলাদেশ ও বিশ্ব ব্যাংকের অংশীদারিত্বের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১ মে ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংকের সদরদপ্তরে ওই অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ওপর একটি সেমিনার আয়োজন করা হবে। সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বক্তব্য দেবেন।

ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের উন্নয়নের জয়যাত্রা ও গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের কার্যক্রম তুলে ধরা হবে। অনুষ্ঠানে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব নিয়ে একটি মাল্টিমিডিয়া প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে।

এ প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ ও বিশ্ব ব্যাংকের অংশীদারিত্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও শিল্পকর্ম তুলে ধরা হবে। একই দিনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিশ্ব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক হবে।

২ মে সকালে প্রধানমন্ত্রীর সাথে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী কর্মকর্তারা একান্ত বৈঠক করবেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানে পি ক্লার্ক প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।

একই দিনে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নিশা দেশাই বিসওয়ালের আমন্ত্রণের যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদলের সাথে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেবেন এবং মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেবেন।

সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ইকোনমিস্টকে একটি সাক্ষাৎকার দেবেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজনে একটি কমিউনিটি ইভেন্টেও উপস্থিত থাকবেন।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিশ্ব ব্যাংকের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা’র সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে। তবে সেই বৈঠকের সময় জানাননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এর আগে ২৯ এপ্রিল বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন জানিয়েছিলেন, এবার কেবল বিশ্ব ব্যাংকের আয়োজনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি সীমাবদ্ধ থাকবে।

ওয়াশিংটন সফর শেষ করে ৪ থেকে ৮ মে যুক্তরাজ্য সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন জানান, ৫ ও ৬ মে লন্ডনে ব্রিটেনের রাজা চার্লস এবং কুইন কনসোর্ট ক্যামিলার রাজ্যাভিষেক হবে।

‘এ অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রণের জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।’

মোমেন বলেন, আগামী ৬ মে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের আগে ৫ মে বিকেলে বাকিংহাম প্যালেসে রাজা ও কুইন কনসোর্টের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠিত হবে।

একই দিনে মার্লবোরো হাউসে রাজার উপস্থিতিতে কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল আয়োজিত কমনওয়েলথ লিডার্স ফোরাম হবে। এসব অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী অংশ নেবেন।
৭০ বছর পর অনুষ্ঠেয় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে প্রায় ১৩০টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।

এ সফরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিশিয়া স্কটল্যান্ডের সৌজন্য সাক্ষাতের সম্ভাবনার কথাও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। এছাড়া, যুক্তরাজ্যের কয়েকজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী লন্ডনের একটি হোটেলে একটি নাগরিক সংবর্ধনায় অংশ নেবেন। সেই সঙ্গে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।

৮ মে লন্ডন থেকে দেশের পথে রওনা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন তাঁর ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।