রাজিব শর্মা »
পর্যাপ্ত ফলন, সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও প্রতিবছরের মতো এবারও রমজানে অস্থির হয়ে উঠেছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ইফতারের অন্যতম পানীয় উপকরণ লেবুর বাজার। লেবু কিনতে অনান্য সময়ের তুলনায় এবছর গুনতে হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি টাকা।
ক্রেতাদের অভিযোগ, সহজে পচনশীল না হওয়ায় সরিয়ে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে অস্থির করার চেষ্টা করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর বিক্রেতারা বলছে, উৎপাদন কম হওয়ায় সরবরাহ কমছে। চাষিদের বাড়তি খরচের কারণে উৎপাদক পর্যায়ে লেবুর দাম বেড়েছে। তবে কৃষি অধিদপ্তর বলছে, গত বছরের তুলনায় এবছর লেবুর ফলন ভালো হয়েছে।
গতকাল সোমবার নগরীর অন্যতম সবজির পাইকারি আড়ত রেয়াজউদ্দিন বাজারের আড়তগুলোর সামনে বসা সবজির দোকানগুলোতে লেবুর দাম বাড়তির এই চিত্র দেখা যায়।
এক পিস লেবু ২৮ টাকা
সবজির আড়ত ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সকল সবজির আড়তে অনান্য সবজির মজুদ স্বাভাবিক দেখা গেলেও, চোখে পড়ার মতো তেমন ছিল না লেবু। তাছাড়া আড়তগুলোর সামনে বসা সবজির দোকানগুলোতে যেসব লেবু বিক্রি করা হচ্ছে তার দাম অনেক চড়া। অনান্য সময় যেসব লেবু প্রতি পিস ২ টাকা করে বিক্রি করতো তা এখন ১৫ থেকে ১৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি সাইজের যেসব লেবু ৩ টাকায় বিক্রি করতো তা খুচরা বাজারে এখন ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর পাইকারিতে কিছু দোকানে প্রতি শত লেবু ৭০০ থেকে শুরু করে ২ হাজার ৫০০ টাকা বিক্রি করেন। আর একট বড় সাইজের লেবু বিক্রি করেছেন ২ হাজার ৮০০ টাকায়। হিসেবে পাইকারিতে প্রতি পিস লেবু বিক্রি হয়েছে ৭ টাকা থেকে ২৮ টাকা পর্যন্ত।
লেবুর দাম বাড়ায় ক্রেতাদের ক্ষোভ
লেবুর দাম বাড়তির কারণে বাজারে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। ক্রেতাদের দাবি ব্যবসায়ীরা সুকৌশলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অস্থির করে তুলছে লেবুর বাজার।
প্রর্বতক মোড় এলাকা থেকে বাজারে লেবু কিনতে আসা রেস্টুরেন্ট মালিক মো. সোহেল বলেন, গত এক সপ্তাহ আগে যে লেবু আমরা কিনেছি ১০০ পিস ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা তা এখন বিক্রি করছে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। বড় সাইজের লেবু কিনতাম প্রতি পিস ৪ থেকে ৫ টাকা তা এখন চারগুণ বাড়িয়ে বিক্রি করছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। এসব ব্যবসায়ীরা মূলত বড় ব্যবসায়ীদের ইন্ধনে বাজারে দাম বাড়াচ্ছে। রেয়াজউদ্দিন বাজারে সবজি ব্যবসায়ী সমিতি থাকলেও তাদের নীরবতাই বলছে, লেবুর দাম বাড়ানোর সঙ্গে ব্যবসায়ী জড়িত। প্রশাসনের তদারকি বাড়াতে হবে।
মরিয়ম বেগম নামের এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রশাসনের বাজার তদারকিতে দুর্বলতার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা তা সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। ফলে ভুগতে হচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ ক্রেতাদের।
এমন চড়া দরে লেবু কিনছেন কি’না জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রমজানে লেবু সাধারণ মানুষের খাবার। যেসব মানুষ দামি পানীয় কিনতে পারেন না তারা লেবুর ওপর ভরসা করেন। এখন ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এমন হয়েছে, কোনটি মানবিক আর কোনটি অমানবিক কাজ তাও ভুলে যাচ্ছে।
বাজার করতে আসা ক্রেতা মো. আরিফুর রহমান বলেন, এবছর ব্যবসায়ীরা আড়ত থেকে লেবু সরিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট করে তুলছে।
‘লেবুর দাম বাড়ানোতে আড়তদারেরা জড়িত না’
বাজারে লেবুর দাম বাড়তিতে বড় ব্যবসায়ী বা আড়তদাররা সম্পৃক্ত বলে ক্রেতারা মন্তব্য করলেও আড়তদারেরা জড়িত নয় বলে জানান রেয়াজউদ্দিন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা।
রেয়াজউদ্দিন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শিবলী ফারুক বলেন, ‘লেবুর দাম বাড়তির কারণ হিসেবে অনেকেই আড়তদারেরা জড়িত মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে রেয়াজউদ্দিন বাজারের আড়তদারেরা জড়িত না। বাজারে বিক্রি করা খুচরা বিক্রেতারা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে লেবু কিনে এনে চড়া দরে বিক্রি করছেন। কোন আড়তেই লেবু নেই। কোন আড়তদার লেবু নিয়ে ব্যবসা করে না। প্রশাসনকে খুচরা বিক্রেতাদের তদারকি করতে হবে।’
চট্টগ্রামেই ৩০ হাজার মেট্রিক টন লেবু উৎপাদন
অনান্য বারের মতো এবারও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের পাহাড়ে পর্যাপ্ত লেবু চাষ হয়েছে। তথ্য মতে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর এই পাঁচ জেলায় ২০২৩ থেকে ২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ২৮৮ হেক্টর আবাদকৃত জমিতে লেবু চাষ হয়েছে। যার মধ্যে ফলন হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৯২ মেট্রিক টন লেবু। ফলনকৃত এসব লেবুর মধ্যে শুধু চট্টগ্রামেই লেবুর উৎপাদন হয়েছে ৩০ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন লেবু।
আর গত অর্থবছরে ২ হাজার ২৬৭ হেক্টর জমিতে ফলন হয়েছে ৩১ হাজার ৬৮১ মেট্রিক টন লেবু। হিসেবে গত বছর থেকে এবছর বেশি উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৯১১ মেট্রিক টন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ থেকে ২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে ১৭ হাজার ৩২৮ মেট্রিক টন। হিসেব করলে গত তিন বছরের চেয়ে চলতি অর্থবছর লেবুর ফলন বেড়েছে প্রায় প্রায় ১৬ হাজার ২৬৪ মেট্রিক টন। এছাড়া সরকারি তথ্যের বাইরেও চট্টগ্রামের বোয়ালখালি, মিরসরাই, বাঁশখালি, পটিয়া, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়াসহ বিভিন উপজেলায় লেবুর চাষ হয়েছে। কাজেই দাম বাড়ার কোন প্রশ্নই আসে না বলে মনে করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপÍর।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বলেন, ‘গত তিন বছরেই লেবুর চাষের আবাদকৃত জমির পরিমান যেমন বাড়ছে, তেমনি ফলনও বাড়ছে। কিন্তু বছরের অনান্য সময় লেবুর দাম স্বাভাবিক থাকলেও রমজান আসলে আমরা দেখি অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়। আমাদের তথ্যমতে গতবছরের তুলনায় এবছর লেবুর ফলন ভালো হয়েছে। এখন ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানো মানে বাজারকে অস্থির করে তোলা।’