সুপ্রভাত ডেস্ক »
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কেন্দ্রে একটি উদ্যানে এক দশক আগে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম নির্মাণ শুরু হয়; তারপর হয় ইজারা দেওয়ার চেষ্টা। এ নিয়ে বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়ালে এক সময় উদ্যানটিই পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ভেতরে সেই জাতিসংঘ পার্ক এখন ১২ কোটি টাকায় নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। আর সেজন্য আগের চার কোটি টাকা খরচ করে বানানো সুইমিং পুল ও জিমনেসিয়াম ভেঙে ফেলা হবে।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে ওই পার্কের ভিতর এক একর জমিতে দুটি সুইমিং পুল ও একটি জিমনেসিয়াম নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন তৎকালীন মেয়র এম মনজুর আলম। ২০১৫ সালের জুনে তা শেষ হয়।
এখন পার্কের মাঝে ওই সুইমিং পুলের ’কোনো উপযোগীতা নেই’ জানিয়ে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি গণপূর্ত অধিদপ্তরের নতুন প্রকল্পে সায় দিয়েছে।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ সেলিম বলেন, “মেয়র মনজুর আলমের সময়ে সমিতির পক্ষ থেকে নিজস্ব খরচে পার্ক সংস্কার এবং শিশুদের জন্য একটি ছোট সুইমিংপুল নির্মাণের প্রস্তাব উনাকে দিয়েছিলাম।
“কিছুদিন পরে সিটি করপোরেশন টেন্ডার করে নিজেরাই সুইমিংপুল নির্মাণ করে। এখানে এত বড় ও ব্যবহার অনুপযোগী সুইমিংপুল বা স্থাপনা আমরা চাইনি। খোলামেলা পার্ক চেয়েছি। যাতে মানুষ শান্তিতে হাঁটতে পারে, শিশুরা খেলতে পারে।”
৬৯ একর আয়তনের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের দায়িত্বে। এর মাঝে ২ দশমিক ১৭ একর আয়তনের ওই উদ্যানের নাম ছিল ‘পাঁচলাইশ পার্ক’।
মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী মেয়র থাকাকালে ১৯৮৮ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তর সংস্কার ও ব্যবস্থাপনার জন্য পার্কের দায়িত্ব দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হাতে। ২০০২ সালে মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পার্কের নাম দেন ‘জাতিসংঘ পার্ক’। আর মনজুর আলম সেখানে বানান সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম।
গত এক দশকে এই উদ্যান ঘিরে বারবার দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। তাতে সুরাহা হয়নি, বরং নাগরিকরা পার্ক ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকেছে।
মনজুর আলমের পর আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র থাকাকালে ২০১৬ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ বছরের জন্য পার্কটি ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এরপর এলিট পার্ক লিমিটেড সেখানে কমিউনিটি সেন্টার, গেস্ট হাউজ ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করলে তখনকার গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে মোশাররফ ও নাছিরের বিরোধ প্রকাশ্য রূপ পায়।
পার্কে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের বিরোধিতা করে কল্যাণ সমিতি রিট করলে ইজারা প্রক্রিয়া স্থগিতের নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত।
পরে ২০১৭ সালে পার্কের উন্নয়নে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় একটি নতুন প্রস্তাব দিলে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় আপত্তি জানায় সিটি করপোরেশন।
দুই বছর বিষয়টি ঝুলে থাকার পর ২০১৯ সালে মোশাররফ ও নাছির একমত হন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তায়ন শেষে সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করবে।
নাছিরের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পর মহামারীতে নির্বাচন আটকে থাকায় সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্বে আসেন খোরশেদ আলম সুজন। সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সাথে আলোচনা করে তিনি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রকল্পের বিষয়ে লিখিত অনাপত্তিপত্র দেন।
সে প্রসঙ্গ ধরে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির নেতা আবু সাঈদ সেলিম বলেন, “সিটি করপোরেশন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ ও লিজ দিতে চাওয়ায় আমরা রিট করেছিলাম। এখন তারা উন্নয়ন প্রকল্পে অনাপত্তি দেওয়ায় আমরা মামলা তুলে দিয়েছি।”
গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, পার্কটি তারা জাম্বুরি পার্কের আদলে গড়ে তুলতে চান।
“মাঝখানে একটা ফোয়ারা থাকবে। চারপাশে ওয়াক ওয়ে, সবুজ এলাকা, ল্যান্ডস্কেপ ও বাচ্চাদের খেলার জায়গা থাকবে।”
তিনি বলেন, নতুন প্রকল্পে প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ কোটি টাকা। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি কিছু পরামর্শ দিয়েছে, সেই অনুযায়ী কিছু সংশোধন করা হবে।
রাহুল গুহ বলেন, নতুন প্রকল্পে সুইমিংপুল ও জিমনেশিয়াম না রাখার প্রস্তাব দিয়েছে কল্যাণ সমিতি।
“পার্কের ভেতর দশমিক ৯০ একর জুড়ে এসব স্থাপনা। সেগুলো থাকলে পার্কের আয়তন ছোট হয়ে যায়। সুইমিং পুল দুটির গভীরতা নিয়েও সমস্যা আছে। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা সেখানে পার্কই চান।
“তাছাড়া সুইমিংপুল ব্যবস্থাপনা একটি কঠিন বিষয়। ব্যবস্থাপনা করবে কে? তাই আমাদের প্রাথমিক প্রস্তাবে ছিল সেগুলো না রাখার।”
১২০ ফুট দীর্ঘ এবং ৫০ ফুট প্রশস্ত সুইমিং পুল দুটির একটি আট ফুট এবং অন্যটি সাড়ে আট ফুট গভীর। জিমনেশিয়ামের আয়তন সাত হাজার বর্গফুট।
এসব বিষয় বিবেচনা করে প্রস্তাব দিতে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও গণপূর্তের প্রতিনিধিসহ ৫ সদস্যের একটি কমিটি করে দেয়। কমিটি গত সপ্তাহে ওই পার্ক ঘুরেও দেখেছে।
কমিটির সদস্যরা সুইমিংপুল ও জিমনেসিয়াম ভেঙে ফেলার বিষয়ে ’একমত হয়েছেন’ বলেন জানিয়েছেন কমিটির একজন সদস্য।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, কমিটির সুপারিশগুলো লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
তবে সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম ভেঙে ফেলার অর্থ, সেগুলো নির্মাণে আগে খরচ হওয়া চার কোটি টাকার পুরাটাই গচ্চা যাবে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ সেলিম বলেন, “আমাদের পরামর্শ মানা হলে আগের প্রকল্পে ওই টাকা অপচয় হত না। তখন কেউ শোনেনি।”
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবীর চৌধুরী বলেন, “যে চার কোটি টাকা জলে গেল, সেই টাকা তো নাগরিকের।”
“ওই প্রকল্পের ডিজাইন নিশ্চয় স্থপতি বা প্রকৌশলীরা করেছিলেন। এখন যে ব্যবহারের অনুপযোগী বলা হচ্ছে, তাহলে কীভাবে সেই নকশা হয়েছিল? নাকি ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টরা নকশা না মেনেই ওই সুইমিং পুল দুটি ও জিমনেশিয়াম বানিয়েছিলেন?”
তিনি বলেন, “এত টাকা খরচ করে একদিন কেউ এসব স্থাপনা ব্যবহার করতে পারল না। তাই রাষ্ট্রের অর্থ খরচের আগে একশবার ভাবা উচিত। জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।”
নতুন প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে ’পাঁচ মাস পরে’ এর কাজ শুরুর বিষয়ে আশাবাদী গণপূর্ত অধিদপ্তর।
আর সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর বলেছেন, “প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির নির্দেশনা অনুসারে টেকনিকাল কমিটিতে আমাদের সদস্য দেওয়া হয়েছে। সেই কমিটি সভা করে রেজুলেশন নিয়েছে। এখন দাপ্তরিক চিঠি পেলে আমরা সুইমিং পুল বা অন্য স্থাপনা অপসারণ করব।”
ওই অপচয় নিয়ে প্রশ্ন করলে স্পষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “চিন্তা ভাবনা না করে কিছু করা হলে অপচয় হয়।”
সূত্র : বিডিনিউজ