রতন কুমার তুরী :
বাংলা সাহিত্যের চিরবিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিসম্ভার যুগে-যুগে বাঙালি জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রযুগে সবাই যখন রবীন্দ্রনাথকেই অনুসরণে ব্যস্ত ছিল, ঠিক তখন একমাত্র নজরুলই সকল ধারা ভেঙে সাহিত্যে নিজের একটা স্বতন্ত্র আসন পাকাপোক্ত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নজরুলকে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি নজরুলের সাথে গড়ে তুলেছিলেন সখ্য। নজরুল প্রেমের কবি, মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি। তবে বিদেশি শাসন ও সামাজিক-ধর্মীয় কূপম-ুকতার বিরুদ্ধে লড়াকু হিসেবে বিদ্রোহীকবিরূপেই আমাদের মানসপটে চিরস্থায়ী আসন দখল করে আছেন তিনি। নজরুল হলেন বাংলা সাহিত্যে সাম্য ও মৈত্রীচেতনারও কবি। যিনি পৃথিবীর তাবৎ শোষিত মানুষের পক্ষে সব সময় বলিষ্ঠ হাতে কলম ধরেছেন। তাঁর সমস্ত সৃষ্টিসম্ভার জুড়েই রয়েছে এই মানববন্দনা। মানুষের অধিকারের পক্ষে কলম ধরতে গিয়ে নজরুল কখনও কারো জাতকুল বিচার করেননি। একই চেতনা থেকেই শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামি সঙ্গীত, ভজন, কাওয়ালিও রচনা করেছেন। জীবনের সকল বাঁকে তাঁকে যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হয়েছে। কখনও মসজিদে মুয়াজ্জিনের চাকরি করেছেন, কখনও লেটোদলের গায়ক হয়েছেন। কখনওবা চায়ের দোকানে রুটি বেলেছেন। আবার অলইন্ডিয়া রেডিওতে গান লিখে ও সুর দিয়েও জীবিকানির্বাহ করেছেন। কলকাতা শহরে তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী ও বন্ধু ছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন মুক্তমনা। তাঁরা নজরল প্রতিভাকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁরা সব সময় নজরুলকে দেখতে চেয়েছেন সাহিত্যের উঁচু আসনে। নজরুলের লেখনী এতোই ক্ষুরধার ছিল যে, ইংরেজরা তাঁর কোনো বই বের হলেই সাথে সাথে তা নিষিদ্ধ করতো। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ইংরেজদের দুঃশাসন থেকে ভারতবাসীকে রক্ষা করার জন্য নজরুলের লেখনী তৎকালীন সময়ে মানুষের মনে বড় বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নজরুলের মতো ব্রিটিশবিরোধী কলম ধরতে সাহস করেননি। নজরুল সাহিত্যের প্রতিটি পরতে আছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুতীব্র প্রতিবাদ। কবিতা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধরচনার পাশাপাশি অসংখ্য গানরচনা করেছিলেন তিনি। এসব গানের বেশির ভাগই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রচারিত হয়। বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও নিজকণ্ঠে তাঁর রচিত গান গেয়ে শোনাতেন। নজরুল রচিত সেসব গান সঙ্গীতাঙ্গনে ‘নজরুল সঙ্গীত’ নামে পরিচিত। নজরুল বাংলা সঙ্গীতাঙ্গনকে উপমহাদেশে ভিন্ন ও উঁচুমাত্রা দান করেছিলেন। বিভিন্ন ধর্মের অনুষঙ্গ নিয়ে তিনি অসাধারণ সব গানরচনা করেছেন। সে গানগুলো অতুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে নজরুলের বিপুল গানের বিপুল ভা-ার থেকে একটি গান যুগ যুগ ধরে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা ধারণ করে আছে। গানটি হলো :
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনাদানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্বনিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবনভরে রাখছে রাজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইটপাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোল রে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ॥
এই কালজয়ী গানটি সেই ১৯৩১ সাল থেকেই এ উপমহাদেশে প্রতি রমজানের ঈদের আগে বেতার-টিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতে মহানন্দের সাথে গেয়ে আসছেন বিখ্যাত শিল্পীরা। ঈদের সময় এ গানটি বিভিন্ন জায়গায়-জায়গায় না-বাজলে মনেই হয় না ঈদ এসেছে। গানটি নজরুল মুলত রচনা করেছিলেন স্বনামধন্য গায়কশিল্পী আব্বাস উদ্দিনের অনুরোধে। আব্বাস উদ্দিন কলকাতায় নজরুলের সাথে প্রায়ই কথা বলতে যেতেন। একদিন তাঁর প্রিয় কাজীদা’কে একটি ঈদবিষয়ক গান লিখতে অনুরোধ করলেন এবং বললেন যে স্থানীয় পেয়ারু কাওয়াল ঈদের সময় কত সুন্দর-সুন্দর ইসলামি গানরচনা করে। এমনকি তার গান এইচএমভি কোম্পানি রেকর্ড করে এবং বাজারে বিক্রিও হয় ভালো। এ সময় সামনেই এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানির কর্মকর্তা ভগবতী ব্যানার্জি উপস্থিত ছিলেন। তিনি কথাটি শুনে বললেন, আব্বাস উদ্দিন সাহেব, মুসলিমরা ঈদের দিন গান শোনে না। তাই গান মার্কেট পাবে না। এখানে পুজোর সময় মানুষ গান শোনে। পরবর্তী সময়ে আব্বাস উদ্দিন ভগবতী ব্যানার্জিকে রাজি করিয়েই ছেড়েছিলেন নজরুল কর্তৃক রচিত ঈদের গান এইচএমভি কোম্পানির ব্যানারে রেকর্ডং করার জন্য। এদিকে আব্বাস উদ্দিন তাঁর প্রিয় কাজীদা’কে কোনো মতে রাজি করালেন যে তিনি একটি ঈদের গান লিখবেন। নজরুল কাগজকলম নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন আজকের জনপ্রিয় ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’গানটি। গানটি লিখে নজরুল এটির সূরারোপ করতে চেয়েছিলেন পরে কিন্তু আব্বাস উদ্দিন তাঁকে বললেন, আপনি এখন যেভাব নিয়ে গানটি রচনা করেছেন পরে সূরারোপ করলে তা অবিকল নাও থাকতে পারে। ফলে নজরুল গানটিতে তৎক্ষণাৎ সূরারোপ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে গানটির প্রথম ছত্রেই নজরুল এমন কিছু শব্দ এবং বাক্যের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন যা প্রতিটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছিল। যেমন, গানটির প্রথমেই দীর্ঘ সিয়াম সাধনার পর খুশির ঈদের আগমনীবার্তা দেয়ার সাথে সাথে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য পবিত্র কোরানের কথা উল্লেখ করেছেন। আর তাই ‘আসমানী তাগিদ’ শব্দগুলো বেছে নিয়েছেন। পরবর্তী পংক্তিতে সমাজের ধনীদের সোনাদানা এবং বালাখানা হতে মসজিদ এবং গরিবদের যাকাত দেয়ার কথা বলে সমাজে সাম্য সৃষ্টির আহবান জানিয়েছেন। সম্পূর্ণ ইসলামি ভাবধারায় রচিত হলেও গানটি মানবিকরূপ পরিগ্রহ করেছিল। ফলে সব মানুষের মনে দাগ কেটেছিল। কালজয়ী ঈদের গানটির সর্বশেষ দুটি চরণ সবিশেষ অর্থবহ :
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ। …
একেবারে শেষে সকল মানুষের মনে প্রেমের মসজিদ বানানোর আহবান জানিয়ে নজরল বলেন :
তোরে মারল ছুঁড়ে জীবনজুড়ে ইটপাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোল রে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ। …
আব্বাস উদ্দিন গানটি প্রথম গেয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর উপমহাদেশের অনেক খ্যাতিমান গায়কই এই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় ঈদের গানটি কণ্ঠে ধারণ করেছেন। সেই ধারা এখনও অপ্রতিহত গতিতে বয়ে চলেছে।