দেশের স্বার্থেই বে-টার্মিনালের বাস্তবায়ন জরুরি

সবদিক থেকে প্রবল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও ১০ বছরেও বে-টার্মিনাল প্রকল্পটির কাজ এগোয়নি। ভূমি জটিলতা, পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণ ও পরিবেশের ছাড়পত্র- এ তিনটি প্রধান কাজ বাকি থাকায় আলোর মুখ দেখেনি প্রকল্পটি। তবে সম্প্রতি জানা গেছে এটি বাস্তবায়নে জোর তৎপরতা শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে বে-টার্মিনাল নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের পর ২০১৪ সালের মে মাসে ভূমি বরাদ্দের জন্য আবেদন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে প্রায় ১ হাজার ৬০০ একর ভূমি সমুদ্র থেকে পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় ভূমি আরো বাকি থাকে ৮৫৮ দশমিক ৬৩ একর। এরমধ্যে ৬৬ দশমিক ৮৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হলেও বাকি রয়ে যায় ৭৯১ দশমিক ৭৮ একর জায়গা। পাশাপাশি ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন জমা দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শেলহর্ন ডব্লিউএসপি-একুয়া কেএস। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নকশা ও নির্মাণ পরিকল্পনা জমা দেয় কুনওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটিং কোম্পানি লিমিটেড এবং ডাইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু ব্রেক-ওয়াটারসহ নির্মাণের জায়গা নিয়ে আপত্তি আসলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনাটি রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা চূড়ান্ত না হওয়ায় পরিবেশের ছাড়পত্র পায়নি প্রকল্পটি। তবে, পরিবেশের ছাড়পত্র নিয়ে সিডিএর একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভূমি নিশ্চিত ও পরিকল্পনা করা শেষ হলে পরিবেশের ছাড়পত্র পাওয়া নিয়ে আর কোনো জটিলতা থাকবে না।

প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে থাকবে এ টার্মিনালের স্থাপনা। এর মধ্যে ৬৭ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি ২০২১ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। আরও ৮০৩ একর জমি নামমাত্র বা প্রতীকী মূল্যে পাওয়ার চেষ্টা চলছে। বাকি জমি পর্যায়ক্রমে সমুদ্র থেকে রিক্লেইম করা হবে।

বর্তমানে বন্দরের জেটিতে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে জাহাজ ভেড়ানো হয়। বহির্নোঙর থেকে কোনো জাহাজকে জেটিতে আনতে হলে জোয়ার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ভাটার সময় এ কাজ করা যায় না। এতে জাহাজগুলোকে জোয়ারের অপেক্ষায় বহির্নোঙরে বসে থাকতে হয় । কিন্তু বে-টার্মিনালে দিনরাত সব সময় জেটিতে জাহাজ ভিড়তে ও ছেড়ে যেতে পারবে। জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এখানে ভিড়তে পারবে ১২ মিটার গভীরতা ও ২৮০ মিটার লম্বা জাহাজ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর, ৬ হাজার কন্টেইনার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজও বন্দরে ভিড়তে পারবে। বর্তমানে ১৮০০ কন্টেইনারবাহী জাহাজই বন্দরে ভিড়তে পারে।। পতেঙ্গা-হালিশহর এলাকার সাগরতীর ঘেঁষে প্রস্তাবিত এই টার্মিনাল হবে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোর চেয়েও বড়। চট্টগ্রাম বন্দর বছরে যে পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিং করতে পারে, শুধু বে-টার্মিনালেই হ্যান্ডলিং করা যাবে এর কয়েকগুণ।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিদ্যমান সড়ক ও রেল যোগাযোগের সুবিধা পাবে। এখানে একসাথে ৩৫টি জাহাজ বার্থিং করতে পারবে। জাহাজ ভাড়া কমে আসবে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।
তবে বে-টার্মিনালের কাজ শুরু করতে আরও কিছু জটিলতা রয়ে গেছে এরমধ্যে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ এবং চ্যানেল ড্রেজিংয়ের জন্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লাগবে। প্রকল্পের চারটি অংশের একটি ‘ব্রেকওয়াটার অ্যান্ড অ্যাকসেস চ্যানেল’-এর জন্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছিল বিশ্বব্যাংক। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা এবং এর পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ না হলে, বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেওয়ার ব্যাপারটি আরও এক বছর বিলম্বিত হতে পারে।
অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে বে-টার্মিনাল প্রকল্পটি সরকারের উন্নয়নকর্ম তালিকায় সর্বোচ্চ প্রাধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও তা হয়নি। না হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ তেমন নেই। যা হোক একেবারে না হওয়ার চেয়ে দেরি হওয়াকেও না হয় মানা হলো। তবে সে দেরি যেন আর দীর্ঘ না হয় সেদিকে নজর দিলে রক্ষা।