রতন কুমার তুরী »
১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই সেনাবাহিনী মায়ানমারের বিক্ষোভরত মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করছে। এ নিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ সামরিক বাহিবীর হাতে নিহত হয়েছে। একদিকে চলছে জান্তা বিরোধী বিক্ষোভ অন্যদিকে চলছে সামরিক বাহিনীর নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা। এ বিষয়ে জাতিসংঘ চীন- জাপানসহ আরো কিছু রাষ্ট্রের মায়ানমারের পক্ষে শক্ত অবস্থানের কারণে কিছুই করতে পারছেনা জাতিসংঘ। দৃশ্যতঃ মায়ানমার এখন সেনাশাসনের যাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে। মায়ানমারের ইতিহাসে দেশটির শাসন পদ্ধতিতে সেনাবাহিনী দেশ শাসন করার ধারাবাহিক নজির রয়েছে। দেশটির সংবিধানে সেনাবাহিনীকে এমন কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যার কারণে এটা তারা বারবার করার সাহস পায়। অং সান সুচি দীর্ঘদিন লড়াইয়ের পর ক্ষমতায় আসার আগেও সেনাবাহিনী ক্ষমতায় ছিল। গত নভেম্বরের নির্বাচন সুষ্ঠু হয় নাই এমন অজুহাতে সেনাবাহিনী সুচিকে সরিয়ে দিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করে নিলো।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান, আটক অং সান সুচি সহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। সেনা কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা দ্রুত নির্বাচন দেবে। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধ বাড়ছিলো। গত নভেম্বরের নির্বাচনে সুচির দল সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সেনাদের তরফ থেকেও জানানো হয়েছিল, ভোটে জালিয়াতির বিষয়টি আগে ফয়সালা হওয়া দরকার। মিয়ানমার আগে দীর্ঘদিন সেনাশাসনে ছিল। সুচিও বহুদিন গৃহবন্দি ছিলেন।
সিঙ্গাপুরের সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের মিয়ানমার প্রোগ্রামের একজন গবেষক বলেছেন (অ্যাসোসিয়েট ফেলো) গণতন্ত্রে ফেরার দশ বছরের মধ্যে মিয়ানমার আবার ধাক্কা খেল। তার মতে, এর প্রতিক্রিয়া বিশাল হবে। ১৯৮৮ সালে ছাত্রবিক্ষোভ দমানোর চেষ্টা করেছে সেনারা। কিন্তু সেই সময়ের সঙ্গে এই সময়ের অনেক তফাত। এখন শক্তিশালী সামাজিক মাধ্যম আছে, আমেরিকায় নতুন প্রশাসন এসেছে, চীনের পরিকাঠামো তৈরির উচ্চাকাঙ্খা আছে। তাই সেনার এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াও তীব্র হতে বাধ্য।
সেনাবাহিনী দেশটি কতদিন শাসন করতে পারবে তা এ মুহূর্ত বলা মুশকিল তবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এই পরিস্থিতিতে প্রায় সব দেশই সেনা শাসনের বিরুদ্ধে।
অং সান সু চি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পরও তিনি নিরব থেকেছেন, আন্তর্জাতিক আদালতে সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
গত ২ মাস ধরে মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ চলেছে। সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত ৫৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে শিশু মারা গেছে ৪৩ জন। তবে জনগণের বিক্ষোভের সাথে মিয়ানমারের ১০টি বিদ্রোহী গ্রুপ সমর্থন প্রকাশ করায় এবং বেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী জান্তাবিরোধী অবস্থান নেওয়ায় দেশটি গৃহযুদ্ধের সংঘাতে যেতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। বিক্ষোভকারীরা গেরিলা কায়দায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আহ্বান জানিয়েছে, এর অর্থ সংঘাত আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনে কয়েক হাজার বেসামরিক মানুষ থাইল্যান্ড ও ভারতের মিজোরাম, মণিপুরে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের মুখপাত্র পালিয়ে আসা লোকদের আশ্রয় দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
মিয়ানমারের এই পরিস্থিতি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের কাছে উদ্বেগের। বিশেষ করে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও সেনাবাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও ঝুলে গেছে। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির অবসানে জাতিসংঘের করণীয় রয়েছে, দেশটিতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং সে দেশে বসবাসরত সকল ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ও নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ দ্রুত ব্যবস্থা নিক, বিশ্ববাসী তা চায়।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক