ডা. আইরিন ফেরদৌস :
ডেন্টিস্ট্রি, যা বাংলায় ডেন্টাল বা দন্ত চিকিৎসা নামে পরিচিত। ডেন্টাল চিকিৎসা এবং ডেন্টাল সহায়ক (ডেন্টাল হাইজিন, ডেন্টাল টেকনেশিয়ান, পাশাপাশি ডেন্টাল থেরাপিস্ট) নিয়ে গঠিত। দন্ত চিকিৎসার ইতিহাসে দেখা গেছে যে, মানবজাতির অসুস্থতা ও রোগের সাথে সাথে দন্ত চিকিৎসারও পরিবর্তন ঘটছে। খ্রিষ্টপূর্ব থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দন্ত চিকিৎসার ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতো প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দে, সিন্ধু সভ্যতার প্রথম দিকে দাঁত ড্রিল করা হয়েছে, তার প্রমাণ মেলে ১৯ শতকের সময় মানুষ সুষম স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ডা. জন এম হ্যরিস ১৮৪০ সালে ওহাইওয়ের বেনব্রিজে বিশ্বের প্রথম ডেন্টাল স্কুল স্থাপন করেন, বর্তমানে এটি এখন একটি ডেন্টাল যাদুঘর। ২০ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকার উন্নত দন্ত গবেষণা কেন্দ্রগুলো খোলা হয়েছিলো পাশাপাশি এগুলো আধুনিক হাসপাতাল এর সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। ২০ শতাব্দীর মাঝামাঝি নতুন জৈব দন্ত চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। এই অগ্রগতি, রসায়ন, জেনেটিক্স এবং রেডিওগ্রাফিকের বিকাশের পাশাপাশি আধুনিক দন্ত চিকিৎসা এবং দন্ত চিকিৎসার ঔষধকে নেতৃত্ব দেয়।
বাংলাদেশের মেডিক্যাল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), বাংলাদেশ মেডিক্যাল কাউন্সিল আইনের অধীনে গঠিত হয়েছিল। এই আইনটি ১৯৭৩ সালে করা হয়েছিল সুতরাং এটি বাংলাদেশ মেডিক্যাল কাউন্সিলের ১৯৭৩ আইনও বলা হয়। এর কাজটি হলো মেডিক্যাল ও ডেন্টাল গ্রাজুয়েটদের বাংলাদেশে চিকিৎসা এবং ডেন্টিস্ট্রি অনুশীলনের জন্য নিবন্ধন দেওয়া।
আমরা শরীরের যে কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের যে ভাবে যত্ন নেই, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাঁতের সংরক্ষণ বা দাঁতের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেই না। বলতে গেলে ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝিনা’। কিন্তু বিশেষজ্ঞের মতে, শরীরের যে কোন অঙ্গের মতো দাঁতের সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। সহজ করে বলি দাঁতের রোগের সাথে আমাদের শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সমধর্মী সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, আপনার দাঁতের সমস্যা হলে মুখের লাবণ্য হারানোর সাথে সাথে আপনি খাদ্য ঠিকমতো চিবিয়ে খেতে পারবেন না, ফলে আপনার পাকস্থলীতে সমস্যা দেখা দেবে। আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লিভার এবং কিডনির সাথে দাঁতের রোগের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। আপনার যদি ক্রনিক ডেন্টাল ডিজিস থাকে, এর দ্বারা আপনার লিভার এবং কিডনির ক্ষতি হতে পারে। একবার আপনার লিভার এবং কিডনির ক্ষতি হলে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা করতে হবে, তা থেকে দাঁতের যতœ নিলে আপনার স্বাস্থ্য ব্যয় এবং খরচ উভয়ই অনেক কম হবে। একবার দাঁতের সমস্যা বা ইনফেকশন হলে মাথা ব্যথা, চোখে কম দেখা, কানের সমস্যা সহ বিশেষজ্ঞের মতে অনেক সময় চোখে যে কোন অপারেশন করা যায়না। দ্যা ইউএস পাবলিক হেলথ সার্ভিস এবং আমেরিকান হেলথ রিসার্সে দেখা গেছে যে, হার্টের সমস্যা যেমন ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট থাকলে দাঁতের সার্জারির সময় হার্টের বিশেষ সমস্যা হতে পারে।
দ্যা ইউএস ন্যাশনাল হেলথ অব সায়েন্স এবং দ্যা আমেরিকান মেডিক্যাল ও ডেন্টাল রিসার্সে একদল মার্কিন বিজ্ঞানী একটি নতুন এবং চমকপ্রদ তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তারা দেখেছেন যে, যাদের ক্রনিক ডায়াবেটিস এবং লিভারের সমস্যা রয়েছে, তাদের মুখে দুর্গন্ধ হয়। তাদের মতে দুর্গন্ধ দূরীকরণের জন্য লিভার এবং ডায়াবেটিস এর চিকিৎসার সাথে সাথে দন্তের ও চিকিৎসা প্রয়োজন।
একজন মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার হিসেবে আমি অনেক দন্ত রোগীকে দেখেছি যারা দাঁত ব্যথা নিয়ে আসে এবং চিকিৎসার পরিবর্তে দাঁত তুলে ফেলতে আগ্রহী থাকে। সেক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো মাথা ব্যথা হলে যেমন আমরা মাথা কেটে ফেলি না তেমনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিকিৎসার মাধ্যমে দাঁতের ব্যথা বা দাঁতের সমস্যা সম্পূর্ণরূপে ভাল করা সম্ভব। এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে শহরে তো বটেই, এমনকি জেলা শহরেও রোগাক্রান্ত দাঁতকে দীর্ঘমেয়াদি সুস্থ ও সবল রাখতে সব আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। মনে রাখতে হবে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত টেকনলোজি ব্যবহার করে এবং রেজিস্টার্ড ডাক্তার দ্বারা জীবাণুমুক্ত পরিবেশের মাধ্যমে দাঁতের চিকিৎসা করা উচিত, প্রসঙ্গত কোয়াক ডাক্তার দ্বারা মূল্যবান দাঁতের চিকিৎসা করালে দাঁতের ক্ষতির সাথে সাথে আপনার জীবনেরও ক্ষতি হতে পারে। এখন আসি দাঁতের ও মুখের সাধারণ রোগের লক্ষণ, প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের উপায় সমূহে।
আমারা মুখ দিয়ে যা কিছু খাই, তাই আমাদের পাকস্থলীতে যায় এবং করোনা ভাইরাস এর অন্যতম প্রবেশদ্বার মুখ। সুতরাং মুখ এবং দাঁতের সুস্থতার সাথে সারা শরীরের সুস্থতা জড়িত। অন্যভাবে বলি মুখের সুস্থতার সাথে দেহের সুস্থতা জড়িত। যেমন ব্রেস্টফিডিং মহিলা যা খাবে বা যা গ্রহণ করবে তা খাদ্য চক্রের মাধ্যমে বাচ্চার দেহে প্রবেশ করে, সুতরাং নিজে সুস্থ থাকলে হবেনা অন্যকে সুস্থ রাখার জন্য হলেও মুখ ও দাঁতের যতœ নিতে হবে।
দাঁত এবং মুখে যে সমস্ত রোগ হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো মুখে ঘাঁ, এটি আবার দুটি কারনে হতে পারে যেমন স্থানীয় কারণ, অন্যটি সাধারণ কারণ। স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেন্টাল ক্যারিজ বা দন্তক্ষয়, অনেক সময় ফিলিং করার ক্ষেত্রে বা জন্মগতভাবে মানুষের আঁকা বাঁকা দাঁতের কারণে, ঘর্ষণে মুখে ক্ষত বা ঘাঁ হতে পারে । অনেক সময় ভিটামিন ‘বি’ ডেফিসিয়েন্সি কারণে মুখে ঘাঁ হতে পারে, এখানে বুঝতে হবে রোগীর আসলে কি কারণে ঘাঁ হয়েছে এবং তা সঠিকভাবে সনাক্ত করে সে অনুসারে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে । এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুখের ঘাঁ যদি তিন সপ্তাহের বেশি হয়, অর্থাৎ ২১ দিনের বেশি হলে, তবে আপনাকে অবশ্যই বায়োপসি করতে হবে অর্থাৎ উক্ত জায়গা থেকে একটি ছোট মাংস নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোনো ক্যান্সারের জীবাণু আছে কিনা।
দাঁত এমন একটি অঙ্গ যা মানুষ সারাজীবন সব সময় ব্যবহার করে থাকে। তাই এই ব্যবহারের ফলে এক বা একধিক দাঁত দুর্বল বা অসুস্থ হতে পারে। আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েসনের মতে, সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশের সাহায্যে জীবানুমুক্তকরণ চিকিৎসা পদ্ধতিতে রুট ক্যানেল দ্বারা একটি অসুস্থ দাঁতকে বেদনাহীন ও সুস্থ দাঁতে রুপান্তর করা সম্ভব। পরবর্তীতে দুর্বল দাঁতে ক্যাপ পরানোর মাধ্যমে সুস্থ্য দাঁতের মতো কার্যকর করা যায় এবং দাঁত ভেঙে গেলেও এই চিকিৎসা করানো সম্ভব, যা কিনা একজন দক্ষ চিকিৎসক দ্বারা করানো উচিত।
বিশ্বসাস্থ্য সংস্থার মতে তৃতীয় বিশ্বে যে ধরনের ক্যান্সার হয় তার মধ্যে মুখের ক্যান্সার অন্যতম। বিশেষ করে যারা তামাক,জর্দা বা গুল ব্যবহার করে। তাদের গবেষণা মতে এটা প্রমাণিত, একমাত্র যারা ধূমপান করেন প্রতিটি শলাকা ব্যবহারে রয়েছে ৭৫০০ রাসায়নিক পদার্থ, এবং এর মধ্যে ৭০টি হচ্ছে ‘ক্যাসেনাল জেনিক’ বা ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন জোর দিয়েই বলছে করোনা ভাইরাস এর সাথে ধূমপানের একটি সম ধর্মীয় সম্পর্ক রয়েছে। আমার পরামর্শ হলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বদঅভ্যাসগুলো বর্জন করতে হবে।
আমাদের আরও একটি সাধারণ সমস্যা হলো মুখে দুর্গন্ধ, এটিও সাধারণত দুটি কারণে হয়ে থাকে একটি হলো স্থানীয় কারন, যেমন গামের সমস্যা বা মড়ির সমস্যা। এতে মুখে গন্ধ হয়, এছাড়া মুখের ঘাঁ থেকেও দুর্গন্ধ হতে পারে। অন্য আরও একটি কারণ হলো আপনার যদি অন্যান্য রোগ থাকে যেমন আপনার পাকস্থলীতে সমস্যা, লিভারের সমস্যা ইত্যাদি হলেও আপনার মুখে দুর্গন্ধ হবে। বেশিরভাগ মানুষই দিনে দুইবার ঠিক মতো ব্রাশ করেননা, জ্যাঙ্ক ফুড বেশি খান, ধুমপান করেন, জর্দা গুল ব্যবহার করেন এগুলো হতেও মুখে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। অনেক সময় অনেকের টনসিলের সমস্যা থাকে, গ্যাসের সমস্যা থাকে এগুলো থেকেও মুখে দুর্গন্ধ হয়, সুতরাং আমাদের কাছে একজন পেশেন্ট আসলে তার ইতিহাস জেনে এবং ডায়াগনোসিস করে আমরা ভালো করে বুঝতে পারি কী কারণে মুখে দুর্গন্ধ হচ্ছে এবং সে অনুসারে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে থাকি।
এখন আসি দাঁতের যত্নে সবার জন্য কি করনীয়? ইংরেজিতে একটা কথা আছে। “Prevention is better than cure” অর্থাৎ প্রতিষেধক অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যা, দ্যা ন্যাশনাল রিসোর্স কাউন্সিল অফ ইউএসএ, দ্যা ন্যাশনাল হেলথ অব সায়েন্স (ইউএসএ), দ্যা ইউএস পাবলিক হেলথ সার্ভিস, দ্যা আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোশিয়েশনের বিভিন্ন প্রতিবেদন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যার চুম্বকঅংশ নিম্নে সবার জন্য তুলে তুলে ধরার চেষ্টা করছি, এবং এই মহামারীর সময় বাড়িতে বসে অন্যান্য রোগের মত মুখ এবং দাঁতের যত্ন নেওয়ার জন্য নিম্নলিখিত পরামর্শ দিচ্ছি :
১. এই করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে অবশ্যই ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা মেনে, ৬ মাসে একবার রেজিস্টার্ডডেন্টাল প্র্যাকটিশনারের কাছে গিয়ে মুখ এবং দাঁতের পরীক্ষা করা, বিশেষ করে যাদের দাঁতে ক্যালকুলাস বা প্লাক পড়ে এবং যাদের হার্ট, বহুমুত্র, অধিকন্তু লিভার সমস্যা আছে।
২. করোনা ভাইরাস বিস্তারে মুখ অন্যতম একটি মাধ্যম সুতরাং পূর্ণভাবে বাড়িতে মুখ এবং দাঁতের যত্ন নিতে হবে,অবশ্যই দিনে দুইবার দাঁত ব্রাশ করা উচিত। বিশেষ করে সকালে এবং রাতে খাবারের পরে, সফট টুথ ব্রাশ দিয়ে দাঁত এবং জিহ্বা পরিষ্কার করা উচিত। এখানে উল্লেখ্য যে আমরা যারা দাঁত ব্রাশ করি, কিন্তু সাধারণত জিহ্বা ব্রাশ করিনা বা পরিষ্কার করি না, এই জিহ্বার উপরে সাধারণত সবচেয়ে বেশি ময়লা পরে। আমাদের জিহ্বার উপরে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে, এখানে হাজার হাজার খাদ্যকনা জমে, এগুলো জমে জমে ‘Volatile Sulfur Compounds’ নামে একধরনের গ্যাস তৈরি করে, এই গ্যাসই মূলত দুর্গন্ধের জন্য দায়ী, সুতরাং মাড়ি এবং দাঁত পরিষ্কারের সাথে সাথে জিহ্বাও পরিষ্কার করা উচিত। এক্ষেত্রে বাজারে ভালো ব্রান্ডের ফ্লোরাইড টুথপেষ্ট ব্যবহার করা যেতে পারে এবং অবশ্যই আপনার টুথব্রাশ ৩-৪ মাস পর পর পরিবর্তন করতে হবে এবং বাজারে জিহ্বা পরিস্কার করার অনেক উপকরণ আছে তা ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে সাময়িকভাবে দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়েও পরিস্কার করা যেতে পারে।
৩. অনেকের দেখা যায় দাঁত ব্রাশ করলে বা এমনি এমনি মাড়ি হতে রক্ত বের হয় এটাও দুইটি কারণে হয়। স্থানীয় কারণ, যেটাকে আমরা বলি ডেন্টাল প্লাক, এটা স্কেলিং দ্বারা সারানো যেতে পারে, আরও একটি হলো অজানা কারন, যেমন কারও রক্তে প্লাটিলেট কমে গেলে, বা দীর্ঘদিন যাবৎ ডায়াবেটিস থাকলে সুতরাং সঠিক ডায়াগনোসিস দ্বারা বোঝা যাবে এর কারণ এবং সে অনুসারে রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। সাধারণ কারণের জন্য আমরা যে ধরনের ট্রিটমেন্ট দিয়ে থাকি তা হল : বাজারে অনেক ধরনের মাউথওয়াশ পাওয়া যায়, এগুলো সাধারণত মানুষ ব্যবহার করে থাকে, যার বেশির ভাগই অ্যালকোহল যুক্ত। আমার পরামর্শ হলো, এগুলো বর্জন করে বাসায় তৈরি অল্প গরম লবণ মিশ্রিত পানি দিয়ে গারগেল করা যেতে পারে এবং কুলি করা যেতে পারে, এতে মুখ এবং জিহ্বা গহবরে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারেনা, ফলে রোগীর অন্য কোন সমস্যা না থাকলে দাঁত হতে রক্ত পড়া আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় এবং করোনা রোগীদের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত কার্যকরী হিসেবে পৃথিবীতে প্রমাণিত হয়েছে। এখানে অবশ্যই একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে আপনার মাড়িতে বা মুখে ঘাঁ আছে কিনা, যদি থাকে তবে অবশ্যই পরীক্ষা করে আপনার যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
৪. প্রতিটি মানুষকে অবশ্যই করোনাকালীন সময়ে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। বিশেষ করে সবুজ শাকসবজি, ভিটামিন সি এবং প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। সাথে সাথে জ্যাঙ্ক ফুড পরিহার করতে হবে, সাথে আমার পরামর্শ হলো সব ধরনের চিনি জাতীয় খাবার বর্জন করা উচিত। বিশেষ করে যাদের মুখ গহবর শুষ্ক থাকে এবং মুখে পর্যাপ্তলালা জমে না, সাধারনত তাদের, দাঁতের রোগের সাথে সাথে মুখে দুর্গন্ধ হয়। এ থেকে বাঁচার জন্য সাময়িকভাবে সুগারলেস চুইংগাম বা লজেন্স খাওয়া যেতে পারে বা মুখে এলাচ বা লবঙ্গ চিবানো যেতে পারে।
৫. তামাকের সাথে ফুসফুসের ক্ষতি এবং এর সাথে করোনা রোগের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে সুতরাং সম্পূর্ণরূপে পান, সুপারি, জর্দা এবং নিকোটিন পরিহার করতে হবে। এগুলোর ফলে দাঁতে এবং জিহ্বায় নিকোটিন জমে, উক্ত কারণে মুখে পর্যাপ্ত লালা জমতে বাধা দেয় এবং দাঁতের নানান রোগ হয় সুতরাং পান, সুপারি, জর্দা এবং নিকোটিন এগুলো সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা উচিত।
৬. মহিলারা যখন গর্ভবতী হয় তখন আমরা সাধারনত পরামর্শ দেই পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণের জন্য, কারণ গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের হাড় এবং দাঁতের ভিত্তিরচিত হয়, সুতরাং অনাগত বাচ্চার সুস্থ্য এবং স্বাভাবিক হওয়ার জন্য মায়ের বিশেষ যতœ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
৭. শিশুর ৬ মাস বয়সেই দুধদাঁত আসতে থাকে কোন কারণে যদি এটি না আসে এবং ৬ থেকে ৭ বছরে এই দুধদাঁত পরে স্থায়ী দাঁত আসে এই চক্র যদি না সম্পূর্ণ হয় তবে দেরি না করে অবশ্যই একজন ডেন্টাল সার্জন এর সাথে যোগাযোগ করা উচিত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
৮. বাংলাদেশের অনেক মানুষের পেটে আলসার, গ্যাস এবং বদহজমের সমস্যা রয়েছে এবং যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে তাদেরও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা প্রয়োজন। কারণ এইসব রোগের সাথে দাঁতের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণায় এও দেখা গেছে যারা রেগুলার ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল ব্যবহার করেন তাদের মুখের এবং দাঁতের বিভিন্ন অসুখের জন্য এগুলো দায়ী, সুতরাং এগুলো বর্জন করতে হবে।
৯. গর্ভাবস্থায় মা যদি কোনো কারণে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকেন, তাদের বাচ্চার দাঁতে সমস্যা হতে পারে, সুতরাং যারা এই সমস্যায় পড়ে গেছেন তাদের জন্য আমার পরামর্শ হলো আধুনিক চিকিৎসা দ্বারা সম্পূর্ণভাবে এই সমস্যাগুলো ভালো করা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড ডেন্টিস্টের সাথে যোগাযোগ করুন এবং আপনার সমস্যার সমাধান করুন।
১০. অনেকে আমার কাছে আসেন দাঁতের হলুদ বর্ণের সমস্যা নিয়ে যেটি ব্লিচিং দ্বারা সম্পূর্ণ রুপে সাদা করা সম্ভব, সুতরাং নানা ধরনের ডেন্টাল চিকিৎসা দ্বারা বৈজ্ঞানিক উপায়ে এই সমস্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে ভালো হওয়া সম্ভব।
১১. এখন সারা পৃথিবীব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে এবং তার উপরে যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া সুতরাং চিকনগুনিয়া বা ডেঙ্গু হলে রক্তে প্লাটিলেট কমে, অতএবএটি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দাঁত বা মাড়ি হতে রক্ত পড়তে পারে। এই অবস্থায় প্লাটিলেট স্বাভাবিক হওয়ার চিকিৎসা করতে হবে এবং এরপর যাদের দাঁতের সমস্যা আছে তারা দাঁতের চিকিৎসা করতে পারেন।
১২. আক্কেল দাঁত সাধারণত ১৮ বছরের পরে উঠে, কোন কারণে এটি না উঠলে বা আঁকা বাঁকা হলে, দাঁত এবং মাড়ির এক্সরে করে করে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকি, যা আপনাকে একজন রেজিস্টার্ড ডেন্টাল সার্জন এর পরামর্শে এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
সর্বোপরি আমি একজন রেজিস্টার্ড মেডিক্যাল এবং ডেন্টাল বিশেষজ্ঞ হিসেবে বলতে পারি, ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম দিতে হবে’ কারণ দাঁতের সাথে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গভীর এবং সুস্পষ্ট যোগাযোগ রয়েছে সুতরাং দাঁতভাল থাকলে দেহের প্রবেশপথ ভাল থাকবে এবং করোনা ভাইরাস ও প্রবেশ করতে পারবে না। তাই উন্নত বিশ্বে বলা শুরু হয়ে গেছে ‘Celebration of Birthday once in a year but go to dentist twice in a year’ সুতরাং বছরে দুইবার ডেন্টিস দ্বারা মুখ ও দাঁতের পরীক্ষা করে সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব। এখন ডেন্টিস্টের কাছে গেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে যেতে হবে। একজন মেডিক্যাল প্রাকটিশনার হিসেবে এই মহামারীর সময় আমার পরামর্শ হলো, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ মেনে চলুন, ঘরে থাকুন। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হোন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন, বিষোদগার কিংবা ঘৃণা-বিদ্বেষ না ছড়িয়ে বরং করোনা মোকাবেলায় যারা ফ্রন্টলাইনে আছেন তাদেরকে সমর্থন করুন, সহায়তা করুন। নিজে বাঁচুন, পরিবার ও প্রতিবেশীকে বাঁচান এবং দন্ত চিকিৎসায় উপরিউক্ত পরামর্শগুলো মেনে চলুন। আমি বিশ্বাস করি সুদিন আর বেশি দূরে নয়, করোনার বিরুদ্ধে মানুষের জয় হবেই ইনশাআল্লাহ, এই শুভ কামনায়, সবাইকে ধন্যবাদ।
লেখক : সহকারী ডেন্টাল সার্জন,
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চরভদ্রাসন
ফরিদপুর, ৭৮০০।