‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

ড. মো. মোরশেদুল আলম

‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ চলচ্চিত্রটির নির্মাতা জহির রায়হান। এটি ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামভিত্তিক চলচ্চিত্র’-এর দ্বিতীয় খণ্ড। ১৯ মিনিটের এ প্রামাণ্যচিত্রটি ৩৫ মি.মি. ফরম্যাটে নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রামাণ্যচিত্রটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে চলচ্চিত্রের পর্দায় প্রতিফলিত করার চেষ্টা করে। এতে নির্মাতা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চিত্রায়িত করেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের গঠন, যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার কথা এ ছবিতে প্রতিফলিত হয়েছে। ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এ ছবির গুরুত্ব অপরিসীম। ছবিটির ইংরেজি ধারাভাষ্য বর্ণনা করেন আলমগীর কবির। একটা লংশট দিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি শুরু হয়। পরিচালক এতে অনেক স্থিরচিত্র ব্যবহার করেছেন। এতে ১৯৪৭ সাল থেকে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে গঠিত স্বাধীন বাংলা সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাক্ষাৎকার পর্যন্ত বর্ষ অনুসারে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জহির রায়হান এ প্রামাণ্যচিত্রে বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য শুরু করেছেন ১৯৪৭ দিয়ে, শেষ করেছেন ১৯৭১ এর বিজয় অর্জন দিয়ে। পাকিস্তান আমল তাঁর মূল বিষয় ছিল।

১৯৪৭-এর দেশ বিভাগকে জহির রায়হানের বর্ণনায় পাইÑ ব্রিটিশ শাসক সমগ্র ভারতবর্ষকে রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদিকে বিবেচনা করে দুটি ভাগে ভাগ করে মুসলমান প্রধান এলাকা হস্তান্তরিত করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর হাতে। বাংলা ভাষাভাষী তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হয়। এ স্টেট ইজ বর্ন হচ্ছে বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পাকিস্তানিদের নির্যাতন-নৃশংসতার বিভিন্ন ঘটনার প্রামাণ্য ইতিহাস। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম, জিন্নাহর শপথ গ্রহণ, ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার দাবি, ১৯৫২ সালের রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে সোহরাওয়ার্দী-হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ৯২-ক ধারা জারি, ১৯৫৮ সালে আয়ুব-ইস্কান্দারের নেতৃত্বে সামরিক শাসন, ১৯৬২-৬৫ সালে ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-নজরুল-মনসুর-মুশতাক-কামরুজ্জামান-তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক জীবন, ১৯৬৮-৬৯ সালে ছাত্র ও গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মার্চে গণ ও অসহযোগ আন্দোলন, পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ, স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে মন্ত্রিসভা গঠন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন, মন্ত্রী মনসুর আলী-কামরুজ্জামান-খন্দকার মুশতাকের সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রীয় কাঠামো, আদর্শ-উদ্দেশ্য-রাজনীতি-অধিকার-অর্থনীতি-পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে রূপরেখা।

পরিচালক ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের দৃশ্য দেখানোর সময় প্রতিটি শটকে খুব দ্রুত ব্যবহার করেছেন। এখানে কাট টু কাট শট ব্যবহার করেছেন খুব কম সময়ের মধ্যে। এছাড়াও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করার বর্ণনা এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের কিছু অংশ প্রতিফলিত হয়েছে। চলচ্চিত্রটি শুরু হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ গান দিয়ে। সাথে সাথে পর্দায় ভেসে ওঠে আবহমান বাংলার চিরায়ত প্রকৃতির দৃশ্যাবলি। পর্দা জুড়ে এক একটি সাল ভেসে ওঠে। সাথে সাথেই দেখানো হয় বাঙালির জীবন সংগ্রামের চিত্র। চলচ্চিত্রে একটা ক্লোজআপ শটের সাথে যখন একটা মৃতদেহের বুক থেকে দর দর করে রক্ত বেরিয়ে আসে আর ধারাবিবরণীতে শোনা যায় ‘এন্ড মোর ব্লাড ফ্লোজ’ তখন আমাদের চোখ ভিজে ওঠে। আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে। ক্যামেরায় চিত্রায়িত দৃশ্য ছাড়াও এতে রয়েছে হাতে আঁকা স্কেচ, স্থিরচিত্র, লেটারিং, স্টকশট প্রভৃতি। পর্দায় প্রতিটি সাল যখন ভেসে ওঠে তখন সে সঙ্গে দেখানো হয় বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ ছবির শুরুতেই সুর দিয়ে চলচ্চিত্রকার দৃপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দেন আরেকটি লড়াইয়ের গল্পের কথা। সে লক্ষ্যেই উজ্জীবিত পুরো ছবিটি। এ লড়াই সাম্যের লড়াই। একই সাথে জহির রায়হান প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্যটিও বজায় রেখেছেন অত্যন্ত সুনিপুণতায়। মাঝে মাঝে যুক্ত হয়েছে বর্ণনা আর সম্পূরক দৃশ্যাবলি। একটি পর্ব থেকে আরেকটি পর্বে যেতে মাঝে মাঝেই রক্তক্ষরণের একটি শট। ঠিক এখানেই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের তূরীয় জায়গায় পৌঁছে যায় প্রামাণ্যচিত্রটি। আর বৃহত্তর সাম্যের স্বপ্ন নিয়ে নতুন জন্ম নেয়া দেশের জন্য আবারো লড়াইকে মনে করিয়ে দেয়। এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াই গড়ার লড়াই। মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন সরকার পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় যখন প্রামাণ্যচিত্রটির একটি দৃশ্যে আমরা দেখি, পাকিস্তানিদের ব্যবহৃত গোলা বারুদে চীনা কোম্পানির নাম লেখা আছে। এগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে সংরক্ষিত হয়ে আছে।

যেসব নেতারা বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের ছবি জহির রায়হান এ প্রামাণ্যচিত্রে ব্যবহার করেছেন। তিনি এ ছবিতে ১৯৬৬ সালের পর লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপোষহীন ৬ দফা পেশ, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ইত্যাদি ঘটনাসমূহ যা পরবর্তীকালে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে চূড়ান্ত মোড় নিয়েছিল তা প্রচুর স্থিরচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেন। অবিসংবাদিত মহান এ নেতাকে পরিচালক বিভিন্ন স্থির ও চলমানচিত্রে সার্থকভাবে সীমাহীন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার প্রতিকৃতি ব্যবহৃত হয়েছে, প্রভাবশালী অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরও ছবি প্রতিফলিত হয়েছে এ ছবিতে। কিন্তু জনতার কাছে একমাত্র নির্ভরযোগ্য নেতার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সাথে ব্যবহৃত হয়েছে। সে পাকিস্তানি আমলের শত নির্যাতন আর উত্তাল দিনগুলোর জীবন্ত ফ্রেম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ১৯৭১ সালে প্রবাসী বিপ্লবী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী কামরুজ্জামান-মনসুর আলী যখন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আবেগাপ্লুতভাবে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত একটি জাতির দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাবণ্যের উৎসারমাখা এক অবিস্মরণীয় অতীত।

অস্থায়ী মন্ত্রিপরিষদের কাজ ও পরবর্তী ভাবনা-পরিকল্পনা বিষয়ে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্যদের থেকে গৃহীত সাক্ষাৎকারে উপস্থাপিত প্রশ্নসমূহ ছিল সুচয়িত। প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে জহির রায়হান একটি নতুন রাষ্ট্রের দর্শন, লক্ষ্যকে নিজে যেমন বুঝতে চেয়েছেন তেমনি বোঝাতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষকেও। একই সাথে তিনি ছবিটির উপজীব্য জনপদ তথা পূর্ববাংলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সাথে মিলিয়েও নিতে চেয়েছেন। শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও বঞ্চনাহীন সাম্যের বাংলাদেশের যে আকাক্সক্ষার প্রতিধ্বনি তিনি চেয়েছেন, তা তিনি মানুষের অধিকার, রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ, দর্শনকে প্রশ্ন চয়ন ও উত্তরের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সহজ ভাষায় দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে জহির রায়হান প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দৃশ্যের সাথে সাথে দেশের সামগ্রিক অবস্থা বোঝাতে পেইন্টিংস-এর ব্যবহার করেছেন। পেইন্টিংসগুলোর চমৎকার ব্যবহার হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রটির মন্তাজ। রূপক এ পেইন্টিংসগুলোর মাধ্যমে তিনি পুরো প্রামাণ্যচিত্রটিকে এক ভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রদান করেন।

জহির রায়হান শিল্পকর্ম আর স্থিরচিত্রের সম্মিলন ঘটিয়ে একদিকে বাঙালির অপমান, বঞ্চনা, নির্যাতনের ইতিহাসকে প্রমাণযোগ্য করে উপস্থাপন করেছেন। আরেকদিকে ভাষ্যকার হয়ে পরাধীনতার ইতিহাসকে বিবৃত করেছেন। ভাষ্যকার বলেন, গোটা ভারতবর্ষ একসময়ে ছিল ব্রিটিশ সরকারের আওতাধীন। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এ বাংলার মানুষ সবসময়ই নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত হয়েছে। লড়াকু জাতি যতবারই রুখে দাঁড়িয়েছে, ততবারই ব্রিটিশ সরকার তাদের জনবল আর শক্তি প্রয়োগ করেছে, মুষ্টিবদ্ধ হাত নির্মমভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। রক্তাক্ত হয়েছে বাংলার মাটি বারংবার। শিশু-বৃদ্ধ-নারী-যুবক কেউই রেহাই পায়নি। অত্যাচারী শাসক সাধারণ মানুষের বুক থেকে গঙ্গার জলের মতো রক্ত ঝরিয়েছে। ঘটনাগুলি যখন বর্ণিত হচ্ছিল তখন পর্দায় ভেসে ওঠে এক আহত, রক্তাক্ত বৃদ্ধকে কোলে নিয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ অসহায় এক সন্তান দাঁড়িয়ে আছে। তৎকালীন নির্যাতনের বীভৎস রূপ বর্ণনার জন্য এমন ছবি যথেষ্ট। পরিচালক জহির রায়হান রাজনৈতিক চলচ্চিত্র লেট দেয়ার বি লাইট নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রটির নির্মাণ কাজ শেষ হবার আগেই তিনি নিখোঁজ হন। তিনি ভাষাআন্দোলন নিয়ে একুশে ফ্রেব্রুয়ারি নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি।

লেখক : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়