একটা পুরস্কারের লাগিয়া

রম্যরচনা

মোহাম্মদ নিজাম »

আলী মুন্সী যে তার পিতৃপ্রদত্ত নাম সেটা কেউ জানেই না। পাড়ার লোকে আলু মুন্সী নামেই তাকে চেনে। সেটা কী আলুর ব্যবসা করার কারণে নাকি আলুর মতো গোলগাল মুখাবয়বের কারণে রটেছে, কে জানে। ব্যবসায় বাড়বাড়ন্ত এ আলু মুন্সীর মাথায় আজগুবি এক ব্যামো অকস্মাৎ ঘাই মেরে গেল। এ ব্যামোর নাম বিখ্যাত হওয়ার ব্যামো। একলা হলেই আলু মুন্সী ডুবে যায় সে ভাবনার অতলে।
আহা! কত মানুষ কত কিছু করে বিখ্যাত হয়ে গেল! পরমায়ুর হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়ে গেল অথচ কোনো শাালা তাঁর নামটিই জানলো না। জোনাথন লী থেকে শুরু করে লুইস গারাভিতু, বুচ ক্যসেডিÑ সব শালাই ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাতের তকমা হাইজ্যাক করে গুগলে আর ভূগোলে চকচক করছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আলু মুন্সী গোরস্থানের পাশে বসে নিজেকে নিজেই যেন এসব বলছে।
ওদের মতো আমিও একদিন ঘুমিয়ে যাবো চিরদিনের জন্য। আমি একটা লোক যে বিখ্যাত হওয়ার এ লাগাতার অধ্যবসায়ে পরমায়ু ক্ষয় করছি তিলে তিলে, কেউ কোনোদিন জানবেও না। আহারে সিলেটের ছক্কু ছয়ফুরের মতো একটা জীবনও তো আমার হলো না!
অকস্মাৎ তার এ দীর্ঘমেয়াদি আক্ষেপের বেলাভূমিতে আশার একটা ঢেউ এসে লাগল। সানা গাঙ্গুলী এ মাত্র তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। তার এ আশার পিদিমও নিবে গেল পরের দিনই, যখন দেখল কাজী নজরুল ইসলাম আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ার এ ফেক জগতকে সেদিনই সে গুডবাই জানিয়ে দিল। কিন্তু বিখ্যাত হওয়ার ব্যামোটা কোনো মতেই মাথা হতে বের করতে পারল না। লক্ষ্মী আর বেশিদিন তাকে এ নৈরাশ্যের ঘেরাটোপে আটকে রাখলো না। মওকা একদিন সত্যি সত্যি মিলেই গেল।
নন্দন একাডেমির চন্দন দা’র সাথে তার পরিচয় হয় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। হাসতে-হাসতে চন্দন দা কহিলেন, এ আর এমন কী! খামাকা প্রেসার বাড়ায়েন না। এ তো আমার বাঁ হাতের খেল! এ বছর যে কান্তা একাডেমি হতে বুড়োতোষ সাহিত্যে পুরস্কার পেল সেই মোকসেদ মামুন, তাঁর নাম নিশ্চয় শুনেছেন? মন্ত্রীর হাত হতে পদক নেয়ার সে অনুষ্ঠান তো সব চ্যানেলেই লাইভ টেলিকাস্ট করলো পরশু, দেখেননি? আলু মুন্সীর উত্তরের জন্য কোনো যতি না দিয়েই চন্দন দা বলেই চলেছেনÑ ও সাহিত্যের ‘স’ও তো বুঝে না। সব কাজ তো আমিই করিয়েছি।
আলু মুন্সী গলা হতে ফসকে বেরিয়ে এলো, কিন্তু কীভাবে দাদা?
মাল ছাড়ো তো তামাশা দেখো। কাকে কীভাবে ম্যানেজ করতে হয় সব রাস্তা আমার জানা, বুঝলেন দাদা। আপনি আমাদের ক্লাবের উপদেষ্টা হয়ে যান প্রথমে। আপাতত লাখ খানেক টাকা অনুদান দিলেই চলবে। সামনের শুক্রবারের কবিতাপাঠের আসরে তাহলে আপনাকেই আমরা প্রধান অতিথি করবো।
চন্দন দা’র উল্লিখিত সংলাপ থেকে দুটো বাক্যের খণ্ডাংশ আলু মুন্সীর মনে গেঁথে গেল। তার একটি হলো ‘মন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার’ আর অন্যটি হলো ‘লাইভ টেলিকাস্ট’। খুশির ঠেলায় আলু মুন্সী ওখানেই লিখে দিলেন লাখ টাকার চেক।
শুক্রবার আসতে বাকি আর মাত্র চারদিন। আলু মুন্সীর দুচোখে ঘুম নেই। খাতুনগঞ্জ বাদ দিয়ে চন্দন দা’কে নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন কলকাতার বিগবাজার, সিটি মার্ট, শ্রীনিকেতন আর বর্ধন সুপার মার্কেট। উদ্দেশ্য কবিতাপাঠের আসরে উপস্থিত হওয়ার জন্য রেশমি সিলকের একটা জমকালো পাঞ্জাবি দরকার। অবশেষে সেই আরাধ্য পাঞ্জাবি কেনা হলো মেরিন হোমল্যান্ড থেকে। তবে একটা নয়, দুটো। চন্দন দা’কে তো আর বাদ দেয়া যায় না!
এক ঝটকায় চারদিন কেটে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়লো কবিতাপাঠের আসরের সেই মধু লগন। অনুষ্ঠান কাভার করতে আনা হলো চার-চারটা চ্যানেলের ক্যামেরাম্যানকে।
আজকের অনুষ্ঠানের শিল্পসৌকর্য সাবেকি অনুষ্ঠানগুলোকে ম্লান করে দিল। কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিবর্গের মধ্যখানে বসে আছেন আলু মুন্সী। তাঁর ডানে-বামে প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের চক্রব্যূহ। ঘন-ঘন ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলে উঠছে। ইতোমধ্যে আমন্ত্রিত কবি ও শ্রোতাদের জন্য কপার চিমনি হতে বিরানির প্যাকেটও এসে পড়েছে।
পিনপতন নীরবতা ভেঙে উপস্থাপিকার ঘোষণাা এলো, এখন আপনাদের সামনে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ছড়াকুল শিরোমণি জনাব আলী মুন্সী। করতালিতে অনুষ্ঠান মুখর হয়ে উঠলো। নিন্দুকেরা বলে, ওই করতালির পেছনেও নাকি কপার চিমনির ওই প্যাকেটগুলোর সবিশেষ ভূমিকা ছিল।
আলী মুন্সীর চোখ চকচক করে উঠল আলোচনার কথা শুনে। ‘আলু’ আর ‘চনা’ বিষয়ে তো তাঁর যথেষ্ট ধারণা আগ থেকেই মজুদ ছিল। ফি রমজানে এগুলো নিয়েই তো তিনি কারসাজি করেন। তিনি বলতে লাগলেন, কোল্ডস্টোরেজে আলু মজুদ করার আগে আপনাকে জানতে হবে আলুগুলো কোন্ জায়গার। মিঠাপুকুরের আলু আর মুন্সীগঞ্জের আলুর দাম তো এক হবে না। আর চনার কথা কি বলবো। রমজানের ওই একটা মাসই তো ব্যবসা। সারা বছর তো এটা তেমন চলে না।
বক্তব্যের মাঝখানেই হো হো করে হেসে উঠলো পুরো অডিয়েন্স। বিচলিত হয়ে পড়লেন আমন্ত্রিত অতিথিগণ। আলী মুন্সীকে কিছু বুঝতে না-দিয়ে চন্দন দা’ বললেন, দেখলেন তো দাদা, মানুষ আপনাকে কত পছন্দ করে।
পরে জানা গেল আগত অতিথিবর্গের সম্মানহানির এ কাফফারা দিতে আলী মুন্সীকে রেডিসনে নাকি ডিনার পার্টি থ্রো করতে হয়েছিল।
যাকগে সেসব পুরোনো প্যাঁচাল। এখন তো দেশের সেরা দৈনিকগুলোর সাহিত্যপাতায় আলী মুন্সীর কবিতাও ছাপা হয় হররোজ। শুনছি, সামনের ডায়মন্ড ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত লিস্টে নাকি এই মুন্সির নামও আছে।
কী জানি, এমনি করে হয়তো শঙ্খ একাডেমিও আলী মুন্সীকে অ্যাওয়ার্ড দিয়ে দিতে পারে।
এটা নিয়ে কেউ আশ্চার্য হলে সেটাই হবে একটা বড় আশ্চর্যের বিষয়।