হুমাইরা তাজরিন »
বড় বড় বর্ণে স্পষ্ট লেখা ছিলো ‘ভারতীয় এবং কুকুর প্রবেশ নিষেধ’। সেই নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা তাচ্ছিল্যকে রক্তের মূল্যে গর্বের ইতিহাসে পরিণত করেছিলেন বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
বীরকন্যা প্রীতিলতার স্মৃতি বিজড়িত সেই ‘ইউরোপিয়ান ক্লাব’ সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ছে না। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ভবনটিকে যাদুঘর করার ঘোষণা আসলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে লাগাতার বিপ্লবে বিদায় নিয়েছিল ব্রিটিশেরা। সেই বিপ্লবের অন্যতম নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। যাঁর নেতৃত্বে ১৮৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ সফল করে মাস্টার দা সূর্যসেনের বিদ্রোহীরা। প্রীতিলতা সেই দিন সায়ানাইড পানে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য একজন বিপ্লবী নারীর অমূল্য আত্মাহুতির এই স্মৃতিচিহ্ন বর্তমানে হারাতে বসেছে।
রোববার সরেজমিনে (৩০ জুলাই) নগরীর আমবাগান এলাকার এক তরুণ বাসিন্দার কাছে ইউরোপিয়ান ক্লাবের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি জানান, ইউরোপিয়ান ক্লাব তিনি চেনেন না। ইউরোপিয়ান ক্লাব সম্পর্কে তিনি জানেনও না। এ এলাকার রিকশাচালকেরাও ইউরোপিয়ান ক্লাব চেনেন না।
ইউরোপীয় ক্লাবের গেইটের ভেতরে থাকা পুরাতন ছোট্ট সাইনবোর্ডটির চারপাশে লতাপাতা গজিয়ে সেটি প্রায় ঢেকে গেছে। এগিয়ে গিয়ে দেখা যায় ভবনটির উপরে ইংরেজি বর্ণে লেখা ইউরোপিয়ান ক্লাব শব্দদ্বয়ের ‘এ’ এবং ‘এল’ বর্ণ খসে পড়েছে। তার নিচে লিখা চিটাগং শব্দের ‘ট’ এবং ‘এ’ বর্ণও খসে পড়েছে। ভবনটির চারপাশের দেয়াল ঢেকে গেছে রং বেরঙের পোস্টারে। যেখানে রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের পোস্টারই বেশি। ভবনের গ্রিল দেওয়া বারান্দার মেঝের সিঁড়ি ঘেষে জন্ম নিয়েছে আগাছা। জানলাগুলোর কাঁচগুলোও ভেঙে গেছে। ভাঙা কাঁচের ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখা গেলো প্রথম এবং দ্বিতীয় হল কক্ষটি ফাঁকা। মেঝেতে বিছানো এলোমেলো কাঠগুলো ভাঙা। তৃতীয় কক্ষটিতে চেয়ার টেবিল দেখা যায়। যার উপরে বিভিন্ন নথি পত্র এলোমেলোভাবে ছড়ানো ছিটানো। ধুলোর আস্তরণ দেখে বোঝা যায় বহুদিন ঝাড় পড়েনি সেখানে।
২০১২ সালের ২ অক্টোবর এখানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক ‘প্রীতিলতার আবক্ষ ভাস্কর্য’ উদ্বোধন করা হয়। ২০১৮ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মূখার্জি ক্লাবটি পরিদর্শনে আসেন। এরপর স্থাপনাটিতে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্মৃতি যাদুঘর’ নামকরণ করে নামফলক স্থাপন করা হয়। তবে তখনও এটি যাদুঘরের রূপলাভ করেনি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী ঐতিহাসিক ক্লাবটি দেখতে আসেন। বর্তমানে ক্লাবটিতে ইউরোপিয়ান ক্লাব নামফলকই ব্যবহৃত হচ্ছে।
ক্লাবটি সম্পর্কে মোহাম্মদ সেলিম নামের পাহাড়তলীর এক বাসিন্দা বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক একটা স্থাপনা। আমার বাবা-দাদারা সারাজীবন এর ইতিহাস নিয়ে গর্ব করতেন। তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের বেশিরভাগ এর ইতিহাস সম্পর্কে জানেওনা। প্রীতিলতা নামটা কেউ কেউ চেনে। তবে এর পেছনের গল্পটা জানেনা। মাঝে মধ্যে যে এখানে আসবো সে পরিবেশটা এখানে নেই। স্থাপনাটার যতœ নাই। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে যদি এখানে যাদুঘর হতো তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম ইতিহাস চর্চার সুযোগ পেতো। ভবনটাও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতো।’
এ ব্যাপারে রেলওয়ের সহকারী প্রকৌশলীর দপ্তরের অফিস ইনচার্জ নজরুল ইসলাম বলেন,‘করোনার আগে প্রায় আড়াই তিন বছর হলো এই ক্লাব ভবনটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করা হয়েছে। শুনেছি এখানে যাদুঘর করা হবে। হস্তান্তরের পর থেকে এটি বন্ধ আছে। এখানে আমাদের ( রেলওয়ের) মোট ৫টা দপ্তর। তবে ক্লাবের দপ্তরটা শিফট্ করে অন্যত্র নেওয়া হয়েছে। এখানে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কেউ নেই। এমনিতে আমাদের চৌকিদারেরা আছে। তারা থাকে, তাদের শিফট পরিবর্তন হয়, তারা অনুপস্থিত থাকলে লোকজন ঢুকে পোস্টার সেঁটে দেয়। ’
চট্টগ্রাম প্রতœতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে বলেন, ‘রেলওয়ে থেকে কোনো হস্তান্তর হয়েছে কিনা তো বলা যাচ্ছেনা। আমার জানা মতে, হস্তান্তরের কোনো গেজেট হয়নি। তবুও আমাকে আরো বিশদ জানতে হবে এ ব্যাপারে। যদি প্রতœতত্ত্ব বিভাগের আওতায় যাদুঘর করতে হয় তাহলে অনেকগুলো বিষয় এখানে যাচাই করতে হয়। যেমন ভবনটির প্রতœতাত্ত্বিক গুরুত্ব কতটুকু তা দেখতে হয়।’
ইউরোপিয়ান ক্লাব হস্তান্তর বিষয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করেছে বলে তো আমি জানিনা। আমাদেরকে তো এই বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। আমাদের তো এ বিষয়ে কেউ কিছু বলেনি। এই ক্লাবটার চাবিটা পর্যন্ত রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রেখে দিয়েছে। আমরা বার বার তাদের চিঠি পাঠিয়েছি। তারা আমাদের কোনো চিঠির সদুত্তর দেয়নি। তারা এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন। এ স্থাপনাটির ঐতিহাসিক মূল্য নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।’