রুশো মাহমুদ »
আরবনারীর জীবনাচরণ নিয়ন্ত্রিত। মেয়েদের পুরুষ-অভিভাবকত্বের তত্ত্বটি সৌদিতে আইন দ্বারা স্বীকৃত। স্বামী, বাবা, নিদেনপক্ষে ভাই, এমনকী ছেলে – এদের অনুমোদনের উপরই নির্ভর করে আরবনারীদের জীবন। এটাই সেখানে স্বাভাবিক।
সামাজিক জীবনযাপনে আরবনারীদের ফিরে আসা মাত্রই শুরু হয়েছে। এমনটাই আমরা জানতে পারছি সংবাদসূত্রে। যেটুকু জানি তার চেয়েও বেশি বিস্ময় আমার সামনে বর্তমান হয়ে এলো। গভীর রাতে মদিনা কিং আবদুল আজিজ ইন্টরন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে দিব্য চোখে এক অবিশ্বাস্য অবলোকন করার সুযোগ হলো। যা ছিলো ভাবনারও অতীত। কালো বোরকায় আবৃত সুতনুদের হাতে পুরো এয়ারপোর্টের নিয়ন্ত্রণ। কী সিকিউরিটি, কী ইমিগ্রেশন পোস্ট সর্বত্র সজাগ-সচকিত আরবনারী। ফিঙ্গার প্রিন্ট, কম্পিউটার এন্ট্রি, ক্যামেরা স্ন্যাপ সবমিলিয়ে কর্মচঞ্চল ইমিগ্রেশন পার হলাম মিনিটেরও কম সময়ে। অথচ নিজ দেশের ইমিগ্রেশন পার হতে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, সময়ক্ষেপণতো আছেই।
সৌদি আরবের মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি ২২ লাখ। এরমধ্যে সৌদির স্থানীয় নাগরিক প্রায় ১ কোটি ৮৮ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ। অপরদিকে নন সৌদি বা প্রবাসী হলেন প্রায় ১ কোটি ৩৪ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ। সবমিলিয়ে পুরুষ ১ কোটি ৯৭ লাখ। আর নারী ১ কোটি ২৫ লাখ। দেশটিতে যত মানুষের বসবাস তার মধ্যে ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ হলেন নারী।
রক্ষণশীল দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত সৌদি আরব। শতবর্ষ পরে সৌদি রাজতন্ত্র এখন বদলে যাওয়া পৃথিবীর সাথে সমানতালে চলার চেষ্টা করছে। বাদশাহ হতে উদগ্রীব তরুণ প্রজন্মের একজন দেশের পুরো ভাবমূর্তিই পাল্টে দেওয়ার অভিপ্রায়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সবকিছুই করা হচ্ছে একটি মিশনকে সামনে রেখে সৌদি আরবকে আগামী দিনে আরও সমৃদ্ধিশালী করা। এই পরিকল্পনার নাম ভিশন ২০৩০। এই দশকের শেষ নাগাদ সৌদি আরব তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এক. এমন একটি অর্থনীতি তৈরি করা, যা আর তেলের ওপর নির্ভরশীল নয়। দুই. প্রায় চার কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। তিন. বিশ্ব মঞ্চে দেশটির অবস্থান অক্ষুণ্ন রাখা।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মাথা থেকে আসা বিশাল পরিকল্পনা ভিশন ২০৩০। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জির সহায়তায় ৩৭ বছর বয়স্ক যুবরাজ এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেন। দেশের ভেতরের সংস্কারমূলক কাজের অংশ হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের হাতে সব ক্ষমতা কার্যকরভাবে কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে। তাঁর সংস্কার কার্যক্রমের মূল বিষয় হলো সৌদি আরবকে একচেটিয়াভাবে তেলভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বের করে এনে সেটিকে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ অর্থনীতির ধারায় নিয়ে আসা।
দেশটির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ সালমানের নেতৃত্বে সামাজিক রক্ষণশীলতা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে সৌদি আরব। এর অংশ হিসেবে দেশটিতে নারীদের গাড়ি চালানো, পুরুষ অভিভাবক ছাড়া ভ্রমণসহ বিভিন্ন অধিকার দেওয়া হয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় এবার মহাকাশেও যাচ্ছেন সৌদি নারী।
সৌদি আরবের সশস্ত্র বাহিনীতে নারীদের যোগদানের সুযোগ করে দিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এখন দেশটির সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীসহ কয়েকটি বাহিনীতে সার্জেন্টসহ বিভিন্ন পদে যোগ দিতে পারবেন নারীরা।
এবছরের (২০২৩ সাল) অক্টোবর মাসের পাঁচ থেকে পনের তারিখ পর্যন্ত মদিনা ও মক্কায় অবস্থানকালে সৌদিতে নারী জাগরণের খানিকটা আঁচ পেলাম। এই দুই শহরের হোটেলে যেখানে ছিলাম সেখানে অভ্যর্থনায় পুরুষ সহকর্মীর পাশাপাশি নারীকর্মীদের সাবলীলভাবে কাজ করতে দেখেছি। এসব হোটেলে একাধিক রেস্তোঁরা, যেখানে ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করছে নারী। দীর্ঘসময় ধরে নারীরা যেখানে ঘরবন্দি সেখানে নারীর কর্মব্যস্ততা সত্যিই আশাজাগানিয়া ও অভূতপূর্ব।
মক্কার শপিংমলে পৃথিবীর তাবৎ বড় বড় ব্র্যান্ডের সারি সারি দোকান। সেখানে কাজ করছেন অসংখ্য সৌদিনারী। পারফিউমের দোকানে সুরভি টেস্টার হাতে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণী দাঁড়িয়ে। কাবা শরীফের অতি নিকটে ক্লক টাওয়ারের সামনে ও পাশে বিকেল থেকে রাত অবধি শত শত নারীকে হ্যান্ডব্যাগ, জায়নামাজ, তাসবীহসহ ছোট ছোট নানা জিনিস ফেরি করতে দেখা যায়। হকারদের কেন্দ্র করে ভিড়-ভাট্টা বেড়ে গেলে অনেক সময় পুলিশের তাড়া খেতে হয়। তখন গাট্টি-বোচকাসহ পাশের মলে বা অলিগলিতে ছোটাছুটির বিড়ম্বনায় পড়তে হয় নারী বিক্রেতাদের।
ইসলামে নারীকে পুরুষের অধস্তন করা হয়নি। ইসলাম ধর্মে নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের গন্ডি গৃহাভ্যন্তরে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি, বরং তার সামাজিক অংশগ্রহণ অনুমোদন করেছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করা হয়নি। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নারীকে শিক্ষার অধিকার দিয়েছিলেন। তাঁর সৈন্য বাহিনীতেও নারীরা ছিলেন।
কয়েকজন মহীয়সী আরব মুসলিম নারীর জীবন থেকে নারীর যে ক্ষমতা ও শক্তি তা অনুমান করতে পারি আমরা অনায়াসে।
খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী। তিনি বিবি খাদিজা নামে সমধিক পরিচিত। খাদিজা (রা.) একজন সম্ভ্রান্ত ও সম্পদশালী নারী ছিলেন। পিতা ও প্রয়াত প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও বৃদ্ধির জন্য নানামুখী ব্যবসা পরিচালনা নীতি ও কৌশল অবলম্বন করে দিন দিন ব্যবসায়িক সাফল্যের উচ্চ আসনে আসীন হতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তিনি নিজের যোগ্যতাতেই একজন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন।
ব্যবসায়িক মুনাফার অংশ প্রদানের চুক্তিতে ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন খাদিজা (রা.)। পারিশ্রমিকের পাশাপাশি লভ্যাংশও দিতেন। ব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট লভ্যাংশ প্রদানের শর্তে লোকবল বা ব্যবস্থাপক বা পরিচালক নিয়োগ করাটা ছিল তাঁর ব্যবসায়িক কৌশল।
নারী হওয়ায় তিনি ব্যবসা পরিচালনার কাজে দূর দেশে সফর করতে পারতেন না। এ সমস্যার সমাধানে তিনি এই ব্যবসা নীতিগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বিনিয়োগে কর্মীরা শ্রম দিয়ে অংশীদার হয়ে ব্যবসার লভ্যাংশ গ্রহণ করত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসলামি অর্থনীতির এই পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবসা পরিচালিত হয়। যাকে বলা হয় মুদারাবা নীতি বা পদ্ধতি। বিশেষত বিভিন্ন দেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলোতে এ নীতি ও পদ্ধতি ব্যাপকভাবে অনুসৃত। একশ্রেণির মানুষ অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং আরেক শ্রেণির মানুষ শ্রম ও মেধা খাটিয়ে ব্যবসার উন্নতি ঘটান। এতে দুই পক্ষই লাভবান হন।
প্রথম খলিফা হযরত আবু বকরের কন্যা এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)। তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি ইতিহাস ও সাহিত্যের জ্ঞানার্জন করেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান লাভ করেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাসুল (সা.)-এর দরবারে আসা আরব গোত্রের প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে।
আয়েশা (রা.) সুবক্তা ছিলেন, তাঁর মধ্যে কাব্যজ্ঞানও ছিল। বাবা আবু বকর (রা.)-এর মৃত্যুর পর তিনি একটি শোকগাথা রচনা করেন।
আয়েশা (রা.) উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যরা যখন প্রায় পর্যুদুস্ত, তেমন ঝুঁকির মধ্যেও আয়েশা (রা.) দৌড়ে দৌড়ে আহত সৈনিকদের পানি পান করান।
কোরআন, হাদিস, তাফসির ফিকহ ও ফতোয়া ইসলামি শিক্ষার সব বিভাগেই তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। কোরআন শরীফ তাঁর মুখস্থ ছিল। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত উমর (রা.) ও হজরত উসমান (রা.)-এর খিলাফতকালে তিনি ফতোয়া দিতেন। তাঁকে বলা হতো উম্মুল মুমিনীন বা বিশ্বাসীদের মা।
প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)-এর শাসনকালে খাওলাও বিনতে আল-আজওয়ার বাইজেনটাইন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। আরেক নারী উম্মে ওয়ারাকা বিনতে আবদুল্লাহ, যিনি নারী-পুরুষের যৌথ সমাজে নেতৃত্ব দিতেন। এই মহিয়সী মহিলা বদরের যুদ্ধে যোগ দেন হতাহতদের শুশ্রষার উদ্দেশ্যে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর খলিফা হযরত উমর (রা.) তাঁর ওপরই মদিনার বাজার সমিতির দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর সময়ে নবী-ঘনিষ্ঠদের মধ্যে যাঁরা স্মৃতি থেকে কোরআন সংকলনের কাজে সাহায্য করেছেন, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। উহুদের যুদ্ধে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষে উম্মে উমারা নুসায়বাহ্ নামে আরেক মহিলা যোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। ইনি সরাসরি অস্ত্র ধারণ করেছিলেন এবং যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। এরকম আরও আছে আরবে মুসলিম নারীর জয়গাঁথা।
সৌদি আরবে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, ফলে উপকৃত হচ্ছে দেশটির অর্থনীতি। বিখ্যাত মার্কিন ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোাবালের গবেষণায় দেখা গেছে, সৌদি আরবে নারী কর্মশক্তির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যা ২০১৬ সালের ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে মোট মানবসম্পদের ৩৬ শতাংশ হয়েছে। এই অগ্রগতি ভিশন-২০৩০ এর ৩০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ উদ্যোগের লক্ষ্য নারী কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা।
এছাড়াও, সৌদি আরবে নারী শিক্ষারও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ২০২০ সালে ২৫ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রায় ৩২ শতাংশ নারী কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০১৭ সাল যা ছিল ২৬ শতাংশ।
এদিকে ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংক (এফএবি) ও ওয়েলথব্রিফিং প্রকাশিত এক গবেষণায় জানানো হয়েছে, নারীদের সম্পদ বৃদ্ধি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরবে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, এই অঞ্চলে প্রতি তিনটি নতুন ব্যবসার মধ্যে একটির উদ্যোক্তা নারী।
বিগত ২০ বছরে অনেক নারীকে এই অঞ্চলের পারিবারিক ব্যবসাকে শীর্ষে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। নারীরা মূলধন বিনিয়োগের আগে অনেকের মতামত শোনেন। তারা প্রায়ই কম ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করেন, ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরও ভালো আয়ের দিকে পরিচালিত হয়।
সৌদি আরবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের একটি অভূতপূর্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উদারপন্থা অনুসরণ করে নতুন এক উদার সমাজ বিনির্মাণ করতে কাজ করে যাচ্ছে সৌদি আরব। সৌদি জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ কর্মক্ষম নারী। কাজের সুযোগ পাওয়া নারীশক্তি এই এগিয়ে যাওয়ায় বড় ভূমিকা রাখবে কোন সন্দেহ নেই।
নারী সর্বজয়া, আরবনারী তোমার জয় হোক।