আওয়ামী রাজনীতিতে চট্টগ্রামের ভূমিকা : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

প্রফেসর ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী »

কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি উদ্যাপন উপলক্ষে গত ২৬ নভেম্বর গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সে বক্তৃতা করছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক পর্যায়ে তিনি উচ্চারণ করেন, ‘আমি ঢাকায় থাকলেও, আমার মন পড়ে আছে চট্টগ্রামে’। তাঁর এ উপলব্ধি স্বতঃস্ফূর্ত, সাবলীল ও যথার্থ। কেননা বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, শেখ হাসিনা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম- আমাদের জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকাল-টার্নিং পয়েন্টে বীর চট্টলার ঐতিহ্যম-িত সংগ্রামী ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।

সাগর-নদী-গিরি-কুন্তলা পীর আউলিয়াদের পুণ্য্যভূমি চট্টগ্রামের সমস্ত আবহে রয়েছে বিপ্লবের মন্ত্র। তা সেই সিপাহি বিদ্রোহের হাবিলদার রজব আলী থেকে শুরু করে সূর্য সেন, প্রীতিলতার গৌরবদীপ্ত রক্তাক্ত সংগ্রামের অধ্যায় হয়ে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের ললাটে গৌরবের সুবর্ণ তিলক এঁকে দিয়েছে। উপরন্তু ৭৫-এর মর্মান্তিক পৈশাচিক ট্র্যাজেডির পর, আবার দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সিপাহসালার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশনেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম জনসভা করেছিলেন এই চট্টগ্রামে, ১৯৮২ সালে, আউটার স্টেডিয়ামে। এবারও মহামারি কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে যশোরের পরে বিভাগীয় রাজনৈতিক জনসভায় গুরুত্ব পেলো চট্টগ্রাম।

চট্টগ্রামের সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিলো অচ্ছেদ্য, আত্মিক। চট্টগ্রামের রাজনীতির দুই প্রাণপুরুষ এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল বিভাগ-পূর্ব সময়ে। সেই চল্লিশের দশকে। তার বিবরণী ছড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’র ছত্রে ছত্রে। আর সারা জীবন এই সম্পর্ক-আন্তরিকতা অক্ষুণœ ও অম্লান ছিলো। তার নজির প্রচুর। বঙ্গবন্ধুর ‘৬দফা’ ঘোষণা প্রথমেই হয়েছিলো এই চট্টগ্রামে ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে। জননেতা এম এ আজিজের উদ্যোগে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ এই ৬ দফা ঘোষণার জন্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও যথোচিত স্থান হিসেবে বিবেচিত করেছিলেন চট্টগ্রামকে।

এছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু তারবার্তার মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন তাঁর একান্ত সহযোদ্ধা জহুর আহম্মদ চৌধুরীকে। তারপর এই ঘোষণা বাংলাদেশ হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।

শুধু তাই নয়, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করার জন্যে বিপ্লবী পরিকল্পনা তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র’র সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন চট্টগ্রামের ভূপতিভূষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী) ও বিধানকৃষ্ণ সেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

পক্ষান্তরে, ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত ট্র্যাজেডির পর ফুঁসে ওঠেছিলো চট্টগ্রাম। তখনকার সংগ্রামী যুবারা মৌলভী সৈয়দ ও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নিতে সশস্ত্র পন্থা বেছে নিয়েছিলেন।

এই গৌরবময় ইতিহাসের ধারা এখনো বহমান। করোনা-পরবর্তী ২য় পাবলিক মিটিংয়ে সশরীরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি চট্টগ্রামে। ৪ ডিসেম্বর বিজয়ের মাসেই এই ঐতিহাসিক জনসভা। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুকন্যা নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন। দিন বদলের ব্রত নিয়ে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার ধারাবাহিকতায় ৪র্থ বার ক্ষমতায় আসার সংকল্পে ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে জনসভার জনসংযোগ গুরুত্বপূর্ণ।

৩য় বারের মতো নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামকে বলেছিলেন ‘নিজের শহর’ এবং চট্টগ্রামের দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, লালদীঘি ময়দানে। এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত এখন আমাদের চারপাশে মধ্য গগনের সূর্যের মতো প্রদীপ্ত।

যোগাযোগের মাইলফলক স্বাপ্নিক পদ্মাসেতু উদ্বোধন হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ সাফল্যের সেই মুকুটে আরেক পালক। এই টানেল নির্মাণের ফলে চট্টগ্রামের গুরুত্ব আরো বেড়ে গেছে, চট্টগ্রাম এখন এক সিটির দুই শহর। আমাদের এই টানেল কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কতোটুকু উচ্চতায় পৌঁছেছে, ভাবলেই বোঝা যায়। এছাড়া মহেশখালির মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ ওই এলাকায় একটি ডিপ সি- পোর্ট হচ্ছে। সেদিন থেকেও বেড়ে যাচ্ছে এই অঞ্চলের গুরুত্ব। উপরন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেনের হাইওয়ে ৬ লেনের করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নত করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ সমাপ্তির পথে। এর ফলে সমগ্র পূর্ব এশিয়া সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। আর এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়ের কানেকটিভিটির অংশীদার হবে।

আরো আশার কথা, চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করার চিন্তা-ভাবনা করেছে সরকার। এ লক্ষ্যে সমীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। এছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা খোল-নলচে পাল্টে যাচ্ছে। আরো আনন্দের বিষয় চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত সিআরবিতে হাসপাতাল হচ্ছে না। চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের প্রাণের দাবি ও জনগণের পাল্স অনুভব করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাও আসতে পারে- সিআরবিতে কোনো হাসপাতাল হবে না। ওখানে হবে বঙ্গমাতার নামে অভয়ারণ্য।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চট্টগ্রামের যে যুগান্তকারী ভূমিকা তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। প্রবীণ রাজনীতিক অভিভাবক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। এছাড়া রাঙ্গুনিয়ায় জন্ম চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ এমপি এবং জননেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র, বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষা উপ-মন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এমপি শেখ হাসিনার উন্নয়নের অভিযাত্রায় বিশ্বস্ত এবং রয়েছেন চট্টগ্রাম উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত সহযোদ্ধা, যুবলীগ-ছাত্রলীগ-প্রমুখ।

চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা। রাজনীতিতেও চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম, অনিবার্য। মহাত্মা গান্ধী কথিত- ‘চিটাগাং টু দ্য ফোর’ বা চট্টগ্রাম সবার অগ্রে- এই অমোঘ বাণী বামন্ত্রের সারবত্তা নিয়ে চট্টগ্রাম এখনো শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে। ৪ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় জনসভায় তার প্রতিফলন আমরা প্রত্যক্ষ করবো। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জিডিপির অন্যতম ভিত্তি বীর চট্টলা। রাজনীতির অমিত-শক্তির বীর প্রশবিণী চট্টগ্রাম বঙ্গবন্ধুর মত শেখ হাসিনার কাছেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

সুখী সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ গড়তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারকে ৪র্থ বার ক্ষমতায় আনতে বীর চট্টলা ও সকল স্তরের রাজনৈতিক জনগণ দৃঢ় প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

 

লেখক : সাবেক ডিন

কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও গবেষক।