পাহাড়ী ভট্টাচার্য
মানব ইতিহাসের হাজার বছরের কালপরিক্রমায় আদিম, বন্য ও গুহুবাসের জীবন থেকে পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ¦ালানো আর মাছের কাঁটা থেকে সুইঁ ও পরে চাকার আবিষ্কার, বাষ্পীয় ইঞ্জিনের উদ্ভাবন, শৃঙ্খলিত দাসপ্রথার পরিসমাপ্তির পথ পরিক্রমায় সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বার্তাবহ সুমহান ফরাসী বিপ্লব ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অক্টোবর বিপ্লবের হাত ধরে দু’দুটি মহাযূদ্ধ, অসংখ্য স্ক্র ক্রুসেড-দাঙ্গা-মহামারি-মন্বন্তর-কোভিডের কালবেলা পেরিয়ে মানব সভ্যতা আজ অসম বিশ্বায়ন, পুঁজির দোর্দণ্ড প্রতাপের ও প্রাবল্যের, বিজ্ঞানের অভাবিত অগ্রগতির বিস্ময়কর এক কালপর্ব অতিক্রম করছে।
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ মূলত: কায়িক শ্রমের সাথে সম্পর্কিত। জীবন ধারণ ও যুথবদ্ধতার প্রয়োজন একদিকে যেমন মানুষকে করেছে সক্রিয়, শ্রম-নির্ভর তেমনি অন্যদিকে প্রবলতর উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সৃজনধর্মীও। শ্রমক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর রোবোটিক্সের এ যুগে এসে প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে বহুমাত্রিক পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার।
প্রথমত: অসম বিশ^ায়নের ফলশ্রুতিতে গুটিকয় পশ্চিমা রাষ্ট্রের ও কর্পোরেট হাউজগুলোর হাতে তাবৎ বৈশি^ক সম্পদ ও অর্থ-বিত্ত কুক্ষিগত থাকায়, তাদের অভিপ্রায়ে ও নিয়ন্ত্রণে বৈশি^ক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিশেষত: কৃষি ও উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, শিল্প-বানিজ্য, শ্রম ব্যবস্থাপনা, শ্রম বাজার ও সাধারণ মানুষের জীবনধারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হবার ফলশ্রুতিতে বিশে^র সিংহভাগ দেশে শ্রমজীবী মানুষ কম-বেশি নানামাত্রিক অন্যায়-অনিয়ম-শোষন-বঞ্চনা-বৈষম্য-নিপীড়নের, সার্বিক জীবনমানের ক্ষেত্রে বহুবিধ পশ্চাদপদতার অসহায় শিকার।
অসম বিশ্বায়ন তথা সম্পদের প্রাচুর্য ও অর্থনৈতিক শক্তি যেমন একদিকে গুটিকয় রাষ্ট্রকে দিয়েছে বৈশি^ক রাজনীতিতে একক ও সম্মিলিত মোড়লগিরির সুযোগ, তেমনি অন্যদিকে দিয়েছে দেশে দেশে শিল্প কল-কারখানা স্থাপন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ কিংবা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং স্থানীয় ও বৈশি^ক শ্রম-বাজারে ও শ্রম-ব্যবস্থাপনার স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্বও। বৈশি^ক কর্পোরেট পুঁজির বহমান সংষ্কৃতি প্রভাবিত করছে পৃথিবীর নানা অংশের ভূ-রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে, সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতিকে এবং মোটা দাগে, প্রান্তিক জনজীবনকে। এককথায়, গোটা পৃথিবীজুড়ে আজ সংখ্যাল্প কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারিতা ও কর্তৃত্ববাদিতার বলি ও ভুক্তভোগী হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ জনগণ।
শ্রম ব্যবস্থাপনায় বৈশি^ক পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটেছে অনেক আগেই। কল-কারখানা-শিল্প প্রতিষ্ঠানে যন্ত্র ও প্রযুক্তির নিত্য-নতুনতর সংষ্করণ, উৎর্কষতা বিবেচনায় সর্বশেষ প্রযুক্তির সন্নিবেশন, চলমান অটোমেশন প্রক্রিয়া এবং রোবোটিক্স তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৃদ্ধির প্রবণতা প্রথাগত যাবতীয় পণ্য ও সেবার উৎপাদন-বন্টন-বাজারজাতকরণ-বিস্তৃতি লক্ষনীয়মাত্রায় রূপান্তরিত, সহজসাধ্য, সাশ্রয়ী এবং সময়ানুগ করেছে। একদিকে যেমন কমেছে শ্রমিকের কায়িক শ্রম, অন্যদিকে বেড়েছে যন্ত্র ও প্রযুক্তির প্রভাবে নানাবিধ জটিলতাও । দৃশ্যত, বৈশি^ক শ্রম-চিত্রে প্রবল পরিবর্তন ঘটে চলেছে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যার অনুপাতে, কাজের সুযোগ ও আয়ের স্তরে, শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থাকার অবিভাজ্য প্রশ্নে।
৪র্থ শিল্প বিপ্লবের কাল পেরিয়ে বিশ^ আজ ৫ম শিল্প বিপ্লবের পথে। লক্ষ্যণীয়, এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকাসহ ৩য় বিশে^র দেশে দেশে শ্রমজীবী নারী ও পুরুষ কাজের সমান সুযোগ প্রাপ্তি ও আয়ের স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, অধিকার সুরক্ষা ও মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রশ্নে এখনো উল্লেখযোগ্য স্তরে কিংবা মাত্রায় উপনীত হতে পারে নি। দেখা যাবে ব্রাজিলের সাওপাওলোর সমূদ্রগামী জেলে, পেরুর ভাগচাষী, বলিভিয়ার কয়লা-খনি শ্রমিক কিংবা বাংলাদেশের জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্প, রি-রোলিং মিল কিংবা ট্যানারী শ্রমিক প্রায় একইরকমভাবে স্বল্প মজুরিতে , অনিরাপদ কর্মপরিবেশে, নিয়ত নানামাত্রিক অনিশ্চয়তায় একদিকে যেমন নিজের ও পরিবারের জীবন নির্বাহের স্বার্থে ক্রমাগত জীবন-রস নি:শেষ করছে তখন অন্যদিকে ইউরোপ-আমরিকার সংখ্যাল্প শ্রমজীবী মানুষদের কেউ কেউ স্ব স্ব রাষ্ট্রের নানা সামাজিক সুরক্ষা সুবিধাসমেত একটি তুলামূলকভাবে সেফ ও কমফোর্ট জোনে নিজেদের উপনীত করতে সক্ষম হয়েছে। এহেন বৈপরীত্যই হল অসম বিশ^ায়ন ও ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের এক অনিবার্য বাস্তবতা।
৪র্থ শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে এসেছে গিগ ইকোনোমি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে প্রকাশিত ‘নিউ ইর্য়কার’ পত্রিকার সম্পাদক টিনা ব্রাউন ২০০৯ সালে গিগ ইকনোমি-র ধারণাটি প্রথম তুলে ধরেন। এটিকে ‘শেয়ারিং ইকনোমি’, ‘কোলাবরেটিভ ইকনোমি’ এবং ‘প্লাটফর্ম ইকনোমি’ ও বলা হয়ে থাকে। মূলত: গিগ ইকনোমি বলতে স্বল্প সময়ের জন্য কোন কাজ, অস্থায়ী ধরনের কাজ, চুক্তিভিত্তিক সাময়িক কাজ ও কাজের বাতাবরণে মধ্যস্বত্বভোগীর উপস্থিতি ও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়োগকর্তার স্বাধীন ইচ্ছা-যুক্ত কর্মকে বোঝায়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ব্যক্তির কায়িক ও মানসিক তথা সৃজনশীল দক্ষতার ওপর নির্ভর করে ফ্রিল্যন্সিং, তথ্য-প্রযুক্তিখাতে গ্রাফিক-ডিজাইনিং, বিবিধ কনটেন্ট তৈরি, রাইড-শেয়ারিং, অন-লাইনে নানামাত্রিক সার্ভিস ও হোম-ডেলিভারির কাজে যুক্ত হতে দেখছি আমরা তরুণ প্রজন্মসহ অনেককে। এসবই গিগ ইকনোমির অর্ন্তগত। আজ তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি খাতের পাশাপাশি খাবার, পরিবহন, শিক্ষা, পর্যটন, ইভেন্ট-স্টাফিং/ম্যানেজমেন্ট, স্বাস্থ্য-সেবাখাতেও গিগ ইকনোমির বিস্তৃতি ঘটে চলেছে।
মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে গিগ ইকনোমি একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। এটি সাময়িকভাবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেয়, ব্যক্তির পেশাগত দক্ষতা ও উৎকর্ষতা বাড়ায়, প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার-ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠান-শ্রমিক-মালিক-ভোক্তার একটি স্থানীয় ও বৈশি^ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে এবং পণ্য ও সেবাকে ভোক্তা, গ্রাহক, ক্রেতার জন্য অধিকতর সহজ করে তোলে। বেকার জনগোষ্ঠী, তরুণ প্রজন্ম এমনকি পেশাদারদের জন্য বাড়তি আয়-রোজগারের অনেক পথ খুলে দেয় ও সুযোগ তৈরি করে গিগ ইকনোমি। তবে এর নেতিবাচক দিকসমূহ হল-এটি মূলত অস্থায়ী কাজ, এর অধীনে পণ্য/সেবা বুঝে নিতে গিয়ে গ্রাহক অনেক সময় ঝামেলা তৈরি করে, পণ্য/সেবার আর্থিক দায় শ্রমিককে বহন করতে হয়, আইন ও নীতিমালার অভাবে শ্রমিক-স্বার্থ অরক্ষিত থাকে, এতে প্রযুক্তি ব্যবহারে শ্রমিকের অনভিজ্ঞতা দেখা যায় এবং শ্রমিকের সংগঠিত হবার ও যৌথ দরকষাকষির সুযোগ গিগ ইকোনোমিতে থাকে না।
বাংলাদেশের সংবিধানে-শ্রম আইনে-শ্রম বিধিতে-শ্রম-নীতিতে, রাষ্ট্র স্বাক্ষরিত জাতীয় আর্ন্তজাতিক নানা ঘোষনা-কনভেনশনে, উচ্চ আদালতের বিভিন্ন সময়ের প্রদত্ত রায়ে ও নির্দেশনায় শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক মানবাধিকার স্বীকৃত থাকলেও বাস্তবতা হল এই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষই আজ নিয়ত শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার ভেতর দিনাতিপাত করছে। কোভিডের কালে এবং রাশিয়া-ই্উক্রেন কিংবা ইসরাইল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের কারণে বৈশি^ক প্রেক্ষাপটের বদল আমাদের শ্রম ক্ষেত্রেও অনেক রদবদল ঘটিয়েছে।
উপরোক্ত কার্যকারণের ফলে সাম্প্রতিক কোভিডের কাল থেকে গত ২/৩ বছর ধরে আমাদের মত দেশে প্রতিবছর দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক সংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে কর্মসংস্থান হার কমছে, শ্রমিক কম মজুরীতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, শ্রমিকের ওপর কাজের চাপ বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, শ্রমের পাশাপাশি মালিকের আর্থিক দায়ও বহন করতে হচ্ছে গিগ-শ্রমিককে, দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রম খাতে ছাঁটাই, বরখাস্ত, লে-অফ, চাকুরিচ্যুতি, পাওনা আদায়ে হয়রানি, প্রতিনিয়ত কাজের অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা বৃদ্ধি, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের অনুপস্থিতি, শ্রম আইনের দুর্বল প্রয়োগ প্রবণতা-এসবের বিরূদ্ধে রূখে দাড়ানোর মত দৃঢ় ও শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন-আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপস্থিতি আমাদের দেশের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর জীবনের মৌলিক ও মানবিক অধিকারগুলোকে ক্রমাগত খর্ব করে চলেছে। বিশ^ মানবাধিকার দিবসের আজকের দিনে এ নিয়ে ভাবতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে।