অনলাইনে পাঠদান : অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের কথা ভাবতে হবে

রতন কুমার তুরী »
পৃথিবীব্যাপী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে মানুষ প্রায় অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন পার করছে বহুদিন ধরে। বর্তমানে কিছু কিছু দেশে মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসলেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি পৃথিবী। তবে ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকে যে করোনাভীতি কেটে যাচ্ছে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
এখন মানুষ আর চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থাকতে চাইছে না। ব্যাপক অর্থনৈতিক টানাপোড়েন মানুষকে করোনা পরিস্থিতিতেও লড়ে যাওয়ার সাহস যোগাচ্ছে ফলে মানুষ তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই জীবিকার জন্য ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের পর সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দিয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে। দীর্ঘদিন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় পৃথিবীর কোনো দেশই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খোলা রেখে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে কোনো দেশই চায়নি তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা করোনার মত একটি কঠিন ভাইরাসে সংক্রামিত হোক আর তাই প্রতিটি দেশের সরকার অফিস, কলকারখানা, যানবাহন খুলে দিলেও কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়নি বরং সকল শিক্ষার্থীদের যেকোনো মূল্যে ঘরেই অবস্থান করতে বারবার বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশ এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় শিক্ষার্থীদের তেমন একটা করোনা সংক্রমণ হতে দেখা যায়নি।
মাঝপথে কয়েকটি দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও তা কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতার কারণে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির ধরন হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থেকেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং একটি নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের পাঠ সম্পন্ন করে পরীক্ষায় বসতে হবে। কিন্তু করোনাকালীন পৃথিবীর কোনো শিক্ষার্থীরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হয়নি, এমনকি তাদের নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা দেয়াও সম্ভব হয়নি, এতেকরে শিক্ষার্থীদের বিদ্যাশিক্ষায় চরম ব্যাঘাত ঘটেছে ।
তবে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে ঘরে বসে প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের মাধ্যমে ক্লাস করা সম্ভব হলেও বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা এতদিন সীমিত আকারে প্রচলিত ছিল, কিন্তু করোনাকালিন সময়টি বেশিদিন স্থায়ী হওয়ায় বাংলাদেশেও অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই চালু করতে বাধ্য হয়েছে। বলতে গেলে এই সময়টিতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সচল রাখতে সরকার এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করতে অনেকটা বাধ্য হয়েছে। যদিও অনলাইন পদ্ধতিতে দেশের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করা সম্ভব হয়নি তবুও করোনাকালীন সময়ে এই শিক্ষা পদ্ধতি যথেষ্ট কাজ দিয়েছে। অন্ততপক্ষে দেশের বেশকিছু শিক্ষার্থী ঘরে বসেই তাদের বিদ্যা শিক্ষার চর্চা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে এই অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন শহরভিত্তিক শিক্ষার্থীরা। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীরা অর্থনৈতিক কারণেই স্মার্টফোনের অভাবে এই শিক্ষা পদ্ধতির সাথে সংযুক্ত হতে পারেনি।
তারপরও করোনাকালীন সময়টি বেশ দীর্ঘয়িত হওয়ায় গ্রামীণ পর্যায়েও বেশকিছু শিক্ষার্থীর অভিভাবক ধারদেনা করে অনলাইন ভিত্তিক এই শিক্ষা পদ্ধতিতে যোগ দিয়েছে।
প্রথমদিকে সরকারিভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সংসদ টেলিভিশন এবং বাদবাকি উচ্চ শিক্ষা অনলাইন পদ্ধতিতে নিতে দেখলেও পরবর্তীতে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতিটি প্রাথমিক থেকে একেবারে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। শিক্ষকরা অনেকেই নিজ উদ্যেগে প্রাথমিক, কিন্ডারগার্টেন, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ফলে বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতিতে একেবারে গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত প্রযুক্তির ছোঁয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও এই পদ্ধতিতে গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত হওয়া বেশ কষ্টসাধ্য তবুও অদূর ভবিষ্যতে সরকার এসব দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা করা যায়। এর বাইরে দেশের বিত্তবান এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষাসামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণ করতে পারেন। এর ফলে দেশের সব শিক্ষার্থীই আপদকালীন সময়ে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতিতে সংযুক্ত হয়ে তাদের শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে পারবেন। আর মানুষ দশটি কাজের জন্য দশ জায়গায় ঘোরেনা, প্রযুক্তির সাহায্যে ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমেই দশটি কাজ একসাথে করে, ফলে মানুষ তার সময় ও মেধার অপচয় রোধ করতে সহজেই সক্ষম হয়েছে।
কেবল গ্রাম নয়, শহরের নি¤œবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরাও অনলাইন পাঠ নিতে পারছেনা। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই অধিক। সকল শিক্ষার্থীকে অনলাইন কার্যক্রমে আনতে না পারলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে, ঝরে পড়াও বাড়বে। সরকার যেহেতু বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে, এ ক্ষেত্রে মানব সম্পদ তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। শিক্ষায় বরাদ্দও বাড়াতে হবে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায়।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক