অধিকার আদায়ে প্রত্যয়ী নারী নার্গিস মোহাম্মদী

নোবেল শান্তি পুরস্কার

নিজাম সিদ্দিকী »

‘গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে আমি কখানো পিছিয়ে যাবো না। নিশ্চয়ই এ নোবেল শান্তি পুরস্কার আমাকে এই পথে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, আশাবাদী করে তুলবে এবং এটি আমার গতিকে ত্বরান্বিত করবে।’

এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ইরানের ইভিন কারাগারে আটক মানবাধিকার নেত্রী নার্গিস মোহাম্মদী। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর প্রকাশিত এক পূর্বলিখিত বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন। ইভিনের কারাগারে নারী রাজনৈতিক বন্দিদের বৃহস্পতি ও শুক্রবার ফোন ব্যবহার করার অনুমতি না থাকায় মোহাম্মদী নোবেল ঘোষণার আগেই তার বিবৃতি তৈরি করেছিলেন বলে জানান নির্বাসিত ইরানি ফটোগ্রাফার রেহান তারাবতি। তিনি এবছর ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার আগে ১৪ দিন এই নির্জন কারাগারেই কাটিয়েছিলেন। নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ইরানে নারীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সকলের জন্য মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রচারে তাঁর লড়াইয়ের জন্য নার্গিস মোহাম্মদীকে ২০২৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নার্গিস মোহাম্মদী ইরানের অভ্যন্তরে নারীদের অধিকার এবং মৃত্যুদ-ের বিলোপ এবং কারাগারের অবস্থার উন্নতির জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ইরান সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেছে ১৩ বার, পাঁচবার তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। সব মিলিয়ে ৩১ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে এই সাহসী নারীকে। শরিয়া আইনে ১৫৪টি বেত্রাঘাতের মত শাস্তিও পেতে হয়েছে তাঁকে। নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসেন শুক্রবারের ঘোষণাটি শুরু করেছিলেন ফারসি ভাষায় ইরানে বিক্ষোভের স্লোগান- ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ শব্দ দিয়ে। তিনি বলেন -‘এই পুরস্কারটি ইরানের অবিসংবাদিত নেতা নার্গিস মোহাম্মদীর পাশাপাশি একটি সমগ্র আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। তিনি ইরান সরকারের প্রতি ১০ ডিসেম্বর পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য মোহাম্মদীকে মুক্তি দেওয়ারও আহ্বান জানান। মোহাম্মদী নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ১৯তম নারী এবং দ্বিতীয় ইরানি নারী। ২০০৩ সালে ইরানের মানবাধিকার কর্মী শিরিন এবাদি প্রথম শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।

এদিকে, নোবেল পুরস্কার প্রদানের ১২২ বছরের ইতিহাসে কারাগারে বা গৃহবন্দি থেকে পুরস্কার পাওয়ার তালিকায় মোহাম্মদীর স্থান পঞ্চম। ২০২২ সালে বেলারুশের শীর্ষ মানবাধিকার আইনজীবী আলেস বিলিয়াতস্কি বন্দি অবস্থায় এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। নার্গিসের পরিবার, ইরান সরকার এবং বিশ^ নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া মোহাম্মদীর ভাই হামিদ্রেজা মোহাম্মদি বলেন, ‘এ পুরস্কারের অর্থ হল বিশ্ব এই আন্দোলন দেখেছে, কিন্তু এটি ইরানের পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করবে না। এতে বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর চাপ আরো দ্বিগুণ হবে। তারা মানুষকে পিষে ফেলবে।’ তিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব বলেছেন। যমজ সন্তানসহ প্যারিসে নির্বাসিত জীবনযাপনকারী মোহাম্মদীর স্বামী তাগি রহমানি বলেছেন, পুরস্কারটি তার সংগ্রাম এবং তার নেতৃত্বে থাকা আন্দোলনকে আরও উৎসাহিত করবে। তাদের ছেলে আলী রহমানি বলেছেন, ‘এই পুরস্কারটি ইরানে তার সংগ্রামের জন্য একটি পুরস্কার।’ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘নোবেল কমিটি এর মাধ্যমে সেই সমস্ত নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, যারা তাদের স্বাধীনতা, তাদের স্বাস্থ্য এবং এমনকি তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমি ইরানের সরকারকে অবিলম্বে তাকে এবং তার সহকর্মী লিঙ্গ সমতার প্রবক্তাদের বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’ শুক্রবার ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা লক্ষ্য করেছি যে নোবেল শান্তিকমিটি এমন একজন ব্যক্তিকে শান্তি পুরস্কার প্রদান করেছে যিনি বারবার আইন লঙ্ঘন এবং অপরাধমূলক কাজের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। আমরা এই পক্ষপাতমূলক এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপের নিন্দা জানাই।’

নার্গিসের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা : নার্গিস মোহাম্মদী ১৯৭২ সালের ২১ এপ্রিল ইরানের জাঞ্জানে জন্মগ্রহণ করেন এবং কোরভেহ, কারাজ এবং ওশনাভিয়েহ শহরে বেড়ে ওঠেন। তিনি কাজভিন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করেন এবং একজন পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সংবাদপত্রে নারী অধিকার বিষয়ে নিবন্ধ লিখেন এবং ছাত্রসংগঠন ‘তাশাক্কোল দানেশজুয়ি রোশানগারান’ (‘আলোকিত ছাত্র গোষ্ঠী’) -এর দুটি সভায় গ্রেফতার হন। তিনি একটি পর্বত আরোহী গোষ্ঠীতেও সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু পরে তার রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার কারণে তারা তাঁর পর্বতারোহণে যোগ দেওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। মোহাম্মদী বেশ কয়েকটি সংস্কারপন্থী সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসাবেও কাজ করেন এবং সেই সময়ে রাজনৈতিক প্রবন্ধ নিয়ে The reforms, the Strategy and the Tactics শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। ২০০৩ সালে তিনি নোবেল শান্তিপুরস্কার বিজয়ী শিরিন এবাদির নেতৃত্বে ‘ডিফেন্ডারস অফ হিউম্যান রাইটস সেন্টারে’ (ডিএইচআরসি) যোগ দেন। পরে তিনি এ সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৯৯ সালে নার্গিস মোহাম্মদী তাঁর সহকর্মী সংস্কারপন্থী সাংবাদিক তাগি রহমানিকে বিয়ে করেন। এর কিছুদিন পরে তিনি গ্রেফতার হন। ১৪ বছরের কারাদ- ভোগ করার পর ২০১২ সালে ফ্রান্সে চলে যান ।

আন্দোলন, কারাবারণ
নার্গিস মোহাম্মদী ইরান সরকারের সমালোচনা করার জন্য ১৯৯৮ সালে প্রথম গ্রেফতার হন এবং এক বছর কারাগারে কাটান। এপ্রিল ২০১০ সালের এপ্রিলে তাকে উঐজঈ (‘ডিফেন্ডারস অফ হিউম্যান রাইটস সেন্টারে’)-এর সদস্য হওয়ার জন্য ইসলামী বিপ্লবী আদালতে তলব করা হয়েছিল। ৫০,০০০ মার্কিন ডলারের জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু এর বেশ কয়েক দিন পরে পুনরায় গ্রেফতার হন এবং তাঁকে এভিন কারাগারে আটক রাখা হয়। ২০২১-এর ১৬ নভেম্বর নার্গিস মোহাম্মদীকে আলবোজের কারাজে ইব্রাহিম কেতাবদারের স্মৃতিসৌধে যাওয়ার পথে গ্রেফতার করা হয়, যিনি ২০১৯ সালের নভেম্বরে দেশব্যাপী বিক্ষোভের সময় ইরানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পোশাকবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশের হেফাজতে নিহত তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যুতে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভের সময় বিবিসি নার্গিস মোহাম্মদীর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে আটক নারীদের যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের বিবরণ দেওয়া হয়। চলতি বছরের (২০২৩ সালের) জানুয়ারি মাসে তিনি কারাগার থেকে এভিন কারাগারের মহিলাদের অবস্থা বিশদ বিবরণ দিয়ে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেন, যার মধ্যে ৫৮ জন বন্দির নির্যাতনের বিবরণ উঠে আসে। এই মহিলাদের মধ্যে ৫৭ জন মোট ৮৩৫০ দিন নির্জন কারাবাসে কাটিয়েছেন। এই নারীদের মধ্যে ৫৬ জনকে মোট ৩৩০০ মাসের কারাদ- দ-িত করা হয়েছিল।

ইরানে নারীদের অবস্থান
আধুনিক যুগেও ইরানে নারী ও কন্যাশিশুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর নারীবিদ্বেষী আচরণে জর্জরিত ইরানের নারীদের নিত্যদিনের জীবন। বৈষম্যমূলক আইনের কারণে দিনদিন পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলছে দেশটিতে। ২০২১ সালে জাতিসংঘের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এরকম তথ্য উঠে আসে। সে বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেন জাতিসংঘে ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ দূত ও স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ জাভেদ রেহমান। এতে বলা হয়, জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম বৈষম্যের শিকার ইরানের নারীরা। উদ্বেগ জানানো হয় নারীদের ওপর পারিবারিক সহিংসতা নিয়েও। প্রতিবেদনে নারীদের ওপর অ্যাসিড সন্ত্রাস বন্ধে ইরান সরকারের গৃহীত নতুন আইনের প্রশংসা করা হলেও ইরানে বিয়ের ন্যূনতম বয়স নিয়ে যে আইন রয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানানো হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ইরানে বাবার অনুমতি সাপেক্ষে কন্যাসন্তানের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর। বিচারকের বিশেষ অনুমতি নিয়ে আরো কমবয়সেও মেয়েদের বিয়ে হওয়ার নিয়ম আছে দেশটিতে। ২০২০ সালের ছয় মাসে দেশটিতে ১০ বছর থেকে ১৪ বছর বয়সী ১৬ হাজার কন্যা শিশুর বিয়ে হয়েছে বলে জানান ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ দূত ও স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ জাভেদ রেহমান।

তিনি বলেন, ‘নারী ও মেয়ে শিশুদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে বাল্যবিয়ের প্রশ্ন। দেশের এবং নারীদের উন্নয়নের পথে বাল্যবিয়ে বড় বাধা। শিক্ষা, কর্মসংস্থান আর সহিংসতামুক্ত জীবন-সবকিছুতেই নারীদের পথে বড় বাধা হয়ে থাকছে বাল্যবিয়ে। হয়রানি, গ্রেফতার, কারাদ-ের ভয় নিয়ে কাজ করতে হয় নারী অধিকার কর্মীদের; বিশেষ করে যারা বাধ্যতামূলক পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান সরকারের আক্রমণ থেকে বাদ পড়ছে না নারী, শিশু, মানবাধিকার কর্মী, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী, লেখক, সাংবাদিক ও দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। এমন ব্যক্তিরা। নির্যাতন, নিপীড়ন, হয়রানি, বিচারবহির্ভূত আটক, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা, মৃত্যুদ-সহ নানাভাবে ভোগান্তির শিকার বিপুলসংখ্যক মানুষ। এদিকে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতে ইরানে হিজাব ইস্যুতে নারীদের শনাক্তকরণ ও শাস্তির আওতায় আনতে দেশটি জনসমাগমস্থলে ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইরানে নারীদের পোশাকবিধি না মানার ক্ষেত্রে লাগাম টানতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ঐ বিবৃতিতে পুলিশ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, হিজাব ছাড়া কোনো নারীকে শনাক্ত করা হলে তাকে সতর্কবার্তা পাঠানো হবে। হিজাবের আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কোনো আচরণ ও কর্মকা- সহ্য করবে না। গতবছরের সেপ্টেম্বরে ইরানে নীতি পুলিশের হেফাজতে ইরানে মাশা আমিনি নামে এক তরুণী মারা যান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি পোশাকবিধি লঙ্ঘন করেছেন। এরপর দেশটিতে বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের পর ইরানি আইন অনুযায়ী নারীদের চুল ঢেকে রাখা, তাদের দীর্ঘ ও ঢিলেঢালা পোশাকে শরীর ঢেকে রাখার বিধান জারি হয়। আইন অমান্যকারীদের তিরস্কার, জরিমানা ও গ্রেপ্তারের শিকার হতে হয়। উল্লেখ্য, ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রাউন মূল্যের নোবেল শান্তি পুরস্কারটি আগামী ১০ ডিসেম্বর সুইডিশ শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে অসলোতে প্রদান করা হবে।