ঘূর্ণিঝড় মোখা
টেকনাফে কয়েকটি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কয়েক হাজার ঘর বিধ্বস্ত
আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছে মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ও টেকনাফ প্রতিনিধি
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের বক্ষে থাকা প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের গাছপালা ও বাড়িঘরের বেশ ক্ষতি হয়েছে; গাছচাপায় একজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গতকাল রোববার সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়তে শুরু করে কক্সবাজার জেলার এ দ্বীপে। দুপুরের দিকে বৃষ্টি ও বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। বিকাল ৪টার পর তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
টানা এক ঘণ্টার বেশি প্রচণ্ড বাতাস ও বৃষ্টির পর আবহাওয়া ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে। বিকাল ৫টার পর বেরিয়ে দেখা যায়, রাস্তাঘাটে গাছপালা উপড়ে বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টিনের ও কাঁচা ঘরবাড়ি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, সেন্টমার্টিনে ১২০০ মত ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। তবে জেলাজুড়ে হতাহতের কোনো খবর আমাদের কাছে নেই।’
উখিয়ার বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুস সালাম (৩৮) জানান, ঘূর্ণিঝড়টি কক্সবাজার উপকূল অতিক্রান্তের সময় বাতাসের তীব্র গতিবেগ ছিল। প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম ঘরের ছাউনি রক্ষার। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
পাশাপাশি ১৯ নম্বর ক্যাম্পে অবস্থানরত ছৈয়দ আলম জানান, বাতাসে প্রথমে আমার ছাউনির উপরে যায়, পরে বেড়াও। অনেক চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারিনি। সকাল থেকে না খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে উপোস আছি। এনজিওর এক কর্মী এসে দু প্যাকেট বিস্কুট দিয়ে গেলেন। তা খেয়ে আছি। রাতে চুলো জ্বলবে না। চুলাতে বৃষ্টির পানি।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু দ্দৌজা নয়ন জানান, বাতাসে বেশ কিছু বাড়ি ঘরের ছাউনি ও বেড়া উপড়ে গেছে শুনেছি। আমাদের সাড়ে চার হাজার স্বেচ্ছাসেবক ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে। কেউ অভুক্ত থাকবে না।
ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকূলের বেশ কয়েকটি এলাকা। এসব এলাকার ঘরবাড়ি, দোকানপাট, গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উপড়ে গেছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে বড় ধরনের আঘাত না হলেও বিপদের শঙ্কা কেটে গেছে। আর কোনো ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
মূলত সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব শুরু হয় উল্লেখ করে নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, দুপুর ২টার দিকে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে গতিপথ বদলে মিয়ানমারের দিকে চলে যায় ঘূর্ণিঝড়টি।’
ঘূর্ণিঝড়টি প্রচণ্ড গতিতে প্রথমে মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হেনেছে উল্লেখ করে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আঘাতে সেন্টমার্টিন-টেকনাফসহ উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়ি ভেঙেছে, উপড়ে গেছে গাছপালা। কয়েকজন আহতের খবর পেয়েছি। ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হলেও জলোচ্ছ্বাস হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, আবহাওয়া শান্ত হওয়ার পর লোকজন আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে গেছে।’
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা আবদুল মালেক বলেন, সেন্টমার্টিন উপকূলের ঘরবাড়ির টিন, দোকানপাট, ছাউনি, কাঠ ও বাঁশ উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড়। গাছপালা ভেঙে পড়েছে, দোকানপাট উড়ে গেছে।
টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের বেশ কয়েক এলাকা ও সেন্টমার্টিনের ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে বাতাস, বৃষ্টি কমে গেছে। কোথাও কোথাও গাছপালা ও কাঁচা বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। তবে জলোচ্ছ্বাস হয়নি।’
সেন্টমার্টিন দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানা গেছে, ঝড়ের সময় দ্বীপে যারা অবস্থান করছিলেন তাদের বড় অংশই ছিলেন সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র, হোটেল ও রিসোর্টে। সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে দুই হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঝড় কমে যাওয়ার পর অনেকেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। পুরুষরা আগে বেরিয়ে কাছাকাছি থাকা বাড়িঘর গিয়ে দেখে আসে।
পরে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রসহ নারী ও শিশুদের নিয়ে বাড়িঘরে যায়। তবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন তারাই; যাদের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।সড়কে গাছপালা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও গাছ উপড়ে বাড়িঘরে পড়েছে। বাড়ির সীমানা প্রাচীর পড়ে গেছে। এর মধ্যেই লোকজন বাড়ি ফিরছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কয়েক হাজার ঘর বিধ্বস্ত
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে কক্সবাজারের উপকূলবর্তী উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ত্রাণ, শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়।
ত্রাণ, শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার সামছুজ্জামান নয়ন সাংবাদিকদের বলেন, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কয়েক হাজার স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ঘর একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিছু ঘর সংস্কার করতে হবে। প্রকৃত চিত্র পেতে একটু সময় লাগবে। তবে ঝড় থেমে গেলেও ভারী বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধসের শঙ্কা আছেও বলে জানান অতিরিক্ত কমিশনার।