সুভাষ দে »
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২২ সালের বাজেট পেশ করেছেন জাতীয় সংসদে। এর আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। তাঁর ভাষণে উন্নয়ন ফিরিস্তি রয়েছে, খাতওয়ারি বিশ্লেষণ রয়েছে। বাজেট উত্তর ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব বলে অভিহিত করেছেন। ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দও বাজেটকে স্বাগত জানিয়েছেন। বরাদ্দ খাতের একেবারে তলানিতে রয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, এ খাতে বরাদ্দ মাত্র ৫৮৭ কোটি টাকা, প্রস্তাবিত বাজেটের শূন্য দশমিক শূন্য নয় আট শতাংশ। বাজেটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্য এই নগণ্য বরাদ্দ দেশের শিল্পী, নাট্যকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। তাঁরা চেয়েছিলেন অন্তত বাজেটের ১ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হোক।
রাষ্ট্রের জন্য বণিক পুঁজি প্রয়োজন, তার চাইতেও বেশি প্রয়োজন ‘সামাজিক পুঁজি’। এই সামাজিক পুঁজি হচ্ছে জনসাধারণের মননশীল ও সৃজনশীল মানসসম্পদ ও মানবসম্পদ উন্নয়নের যোগফল। জনসাধারণ যারা শ্রমে, দক্ষতায় জাতির জন্য সকল সম্পদ- সেবা যোগান দেন, আবার তাদের সাহায্যেই সংস্কৃতির সলিলধারা পুষ্টি পায়। আমাদের লোকসংস্কৃতির সঞ্জিবনী ধারা আবহমান কাল ধরে বয়ে চলেছে, তার সূত্রধর হচ্ছেন কবি, শিল্প, সংস্কৃতিকর্মীরা। তাঁদের হাত ধরেই জাতির মানসভুবন উৎকর্ষ লাভ করে। বিশ্বসভায় আমাদের সাহিত্য-সংষ্কৃতি ও শিল্পের যে উদভাসন, তার শিখা জ্বালিয়েছেন এঁরাই। শিল্প, সংস্কৃতির এই অসামান্যতায় আমাদের সমাজের সম্প্রীতি সাধনা মানবিক ও উদারতায়, সহিষ্ণুতায় উজ্জ্বল হয়েছে। আমাদের সমাজের এই মানবিক ধারা করতে সমাজের ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা, ভূমিকা থাকা চাই। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারাটি বেগবান না রাখলে, জাতির সচলতা স্থবির হয়ে পড়বে, সমাজে শ্যাওলা জমবে, জাতি ও রাষ্ট্রের সম্ভাবনা বন্ধ্যা হয়ে যাবে।
শিল্পÑসংস্কৃতি অফুরন্ত শক্তির আধার, এর অন্তর্নিহিত সজাগ ও বিপ্লবী সত্তা বার বার এই জনপদের মানুষদের শক্তিÑসাহস যুগিয়েছে, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর ভাষা আন্দোলনের সংগঠনশক্তি ও ভাষাশহীদদের আত্মদানের মধ্যে তার প্রমাণ মিলেছে। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার মানুষের জাগরণ পর্বে সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলিই রাজনৈতিক আন্দোলনকে গতি দিয়েছে। লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীরা বাঙালির জাতীয় জাগরণ, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনাকে শাণিত করেছেন, আমাদের রক্ত¯œাত সংবিধানের ৪ মৌল নীতি, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র বাঙালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের ভিত্তি।
আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা সাংস্কৃতিক উন্নয়ন যাই বলি না কেন, একে দেশের সর্বত্র গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে দিতে না পারলে, লোকজীবনের মর্মে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির হিরন্ময় আভা পৌঁছাতে না পারলে সমাজ, রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি সুদূরপরাহত। কেবল অবকাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা বৈষয়িক উন্নয়ন জাতীয় সমৃদ্ধির মাপকাঠি নয় বরং রাষ্ট্র কতটা মানবিক হয়ে উঠতে পারলো, জাতির সৃজনশীল-মননশীল আধারগুলি কতটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সেসব সমাজ ও রাষ্ট্রকে কতটা আলোকিত করতে পারলো, তাই বিবেচ্য। আমাদের দেশটি ছোট, কিন্তু বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় আমাদের সঙ্গীত, প্রতœতত্ত্ব, লোকজ ঐতিহ্য, প্রকৃতি স্মারক স্থান পেয়েছে। আমাদের লালনগীতি, পাহাড়পুর বিহার, বাগেরহাট ষাট গম্বুজ মসজিদ, সুন্দরবন, শীতলপাটি, ১লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব হেরিটেজে স্থান পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ বিশ্বের সেরা ভাষণগুলির একটি হিসেবে ইউনেস্কোর রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যে ভাষণটি জাতির আবেগ, আকাক্সক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রাম আর স্বাধীনতার আকুতিকে ধরে রেখেছে, জনগণকে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য তৈরি করে তুলেছে।
এসব আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য জাতীয়তাবোধের পাশাপাশি শিল্পকলা, সংস্কৃতির অপরূপ উদভাসন। আমাদের লোকজীবনে সংস্কৃতির যে প্রাণরস বয়ে চলেছে, শত অভাব-কষ্ট দুর্যোগের মধ্যেও তার প্রবাহ আজো অমলিন, দেশের মানুষ এই অপরূপ বিভূতি নির্মাণ করেছে, সৃজন করেছে। প্রতিটি জেলা, উপজেলা গ্রামে, শহরে আমাদের সংস্কৃতির যে বৈচিত্র্য, যে আলোকরেখা নানা মতভেদ সত্ত্বেও ভাস্বর, সে সবের দ্যুতি ছড়িয়ে দিতে হবে। গানে, কবিতায়, নাটকে, যাত্রাপালা, আবৃত্তি, গ্রামীণ পটচিত্র, নকশী কাঁথার বুননে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরার পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের সুরটিও তুলে আনা চাই। আমাদের দেশের কিশোর-তরুণরা এই বিপুল কর্মযজ্ঞের সারথি, তবে তার জন্যে চাই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। সরকারকে এটি উপলব্ধি করতে হবে যে, সংস্কৃতি মানুষে মানুষে সেতুবন্ধনের, মানবীয় উপলব্ধি জাগ্রত করতে প্রধান অবলম্বন; একে বিকশিত করার, শত ধারায় পুষ্ট করার, নানা বর্ণে বিভাময় করে তোলার হাতিয়ার সংস্কৃতি।
শিল্পকলা ও সংস্কৃতির সংগঠনগুলি, যাঁরা নানাবিধ সংস্কৃতিচর্চায় যুক্ত আছেন তাদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে সাংগঠনিক কর্ম ও আয়োজন তৎপরতা সারা বছর অব্যাহত রাখতে। আমাদের কিশোর-তরুণদের মধ্যে আজ যে হতাশা, অবক্ষয়, বেপথু হবার প্রবণতা তা থেকে তাদের মুক্ত করতে সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নির্মল বিনোদনের বিকল্প নেই। একেবারে ইউনিয়ন-গ্রাম পর্যন্ত সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিনোদনের আয়োজন নিয়ে যেতে হবে।
পঠন পাঠনের অভ্যাস গড়ে তুলতে পাঠাগার আন্দোলন জোরদার করতে হবে আর এটা সম্ভব সরকারের সাহায্যে। বিভিন্ন জেলা-উপজেলার শিল্পকলা একাডেমিগুলোকে পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে হবে, নিজস্ব অবকাঠামো লাগবে, একাডেমিগুলি হবে সংস্কৃতিচর্চার মূল কেন্দ্র। গড়ে তুলতে হবে নানা সামাজিক সংগঠন, কিশোর-তরুণদের ক্লাব। জাতীয় দুর্যোগ, বিপর্যয়ে সমাজের মানুষের হিতসাধনে কিশোর তরুণরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত হবে। শিশু একাডেমির শাখা উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার আয়োজনে বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে বিস্তারিত পরিকল্পনা নেবে। শিল্পসংস্কৃতি চর্চার সংগঠন ও শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, সংগঠকদের জন্য নিয়মিত বরাদ্দ ও প্রণোদনা থাকা চাই। নাট্য ও আবৃত্তিচর্চাকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা গত কয়েক দশকে সামরিক শাসন, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংস্কৃতিকে প্রতিরোধের হাতিয়ার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করেছে, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের শাস্তির দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে।
সংস্কৃতি কর্মীদের এই লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত আছে রাজপথে, উন্মুক্ত মঞ্চে, নাট্য ও আবৃত্তি অঙ্গনে, শিল্পকলার নানা মাধ্যমে সরব ও সক্রিয় আছেন শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা।
আমরা মানবিক সমাজ গড়ার কথা বলি কিন্তু সেটি সংস্কৃতির আয়োজন ছাড়া সম্পূর্ণ হবে না, কেবল রাজধানীতে নয় দেশের সকল প্রান্তে সংস্কৃতির চর্চা নিয়ে যেতে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্যে বাজেটে সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে সংস্কৃতিচর্চা এবং এর নানা আয়োজন সমাজে নানা অপরাধ প্রবণতা, সন্ত্রাস, নৈতিক অবক্ষয়, উগ্র ধর্মীয় মতবাদ, হতাশা ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে পরাক্রান্ত হাতিয়ার। তাই সংস্কৃতির বিকাশ ও দেশের সকলপ্রান্তে এর চর্চা বিস্তৃত করতে বাজেটে আরো বেশি অর্থসংস্থান জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক