রাষ্ট্রীয় সালামে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বিদায়

সুপ্রভাত ডেস্ক »

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় সালাম ও সম্মান জানিয়েছে প্রশাসন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলও তাকে সালাম জানিয়েছে।

শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে ছিলেন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। সবাই এক বাক্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং পরের পাঁচ দশকে তার অবদানের কথা স্মরণ করে বলেছেন, এই মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। খবর বিডিনিউজের।

এই আয়োজনে এসে জাফরুল্লাহেকে ‘আদর্শ বাঙালি’ আখ্যা দিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রয়াত চিকিৎসকের স্বপ্ন পূরণ হলে দেশের মানুষ সুলভে চিকিৎসা পেত।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কফিন আনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলে শ্রদ্ধা নিবেদন।

শহীদ মিনারের কাছে প্যান্ডেল টানিয়ে কালো কাপড় দিয়ে একটা অস্থায়ী মঞ্চে কফিনটি রাখা হয়। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী শিরিন হক, ছেলে বারিশ চৌধুরী, কন্যা মিষ্টি চৌধুরী, বোন আলেয়া চৌধুরী এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আলফাতুন্নেসা।

প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাকে সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন দল, সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। পরে ঢাকার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেদায়েদুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের একটি সুজ্জিত দল তাকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়।

ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, সাদেক আহমেদ খানসহ কয়েকজন বীর বীর মুক্তিযোদ্ধাও তাকে সালাম জানান।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের শিরিন আখতার, জেএসডির আসম আবদুর রব, সিপিবির শাহ আলম, রুহিন হোসেন প্রিন্স ও মঞ্জরুল আহসান, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, গণফোরাম (মন্টু) সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের রেজা কিবরিয়া, নুরুল হক নূর, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এ সময় শ্রদ্ধা জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমিরেটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা, কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার, অভিনেতা রামেন্দ্র মজুমদার, নারী নেত্রী খুশী কবির ও রাশেদা কে চৌধুরীসহ বিশিষ্ট নাগরিকরাও ফুল দেন কফিনে।

গত বুধবার রাতে ধানম-ির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুক্তিসংগ্রামী জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

স্মৃতিচারণ
শ্রদ্ধার পর্ব শেষে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছোট ভাই শহীদুল্লাহ চৌধুরী পরিবারের পক্ষ থেকে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে (সাভার) নিয়ে যাব। ওখানে উনার তার জানাজা হবে। পরবর্তীতে পৌরলৌকিক ক্রিয়া ওখানে শেষ হবে।’

পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘জনাব জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন আদর্শ বাঙালি। উনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষের ডাক্তার শুধু নন, সাধারণ মানুষের জন্য অকৃত্রিম বাঙালি। তাকে নিয়ে গর্ব করার অনেক বিষয় আছে।’

‘তাকে আমি ৬০ বছর ধরে চিনি। তার পরিবারের সঙ্গে, তার ভাই-বোনদের কয়েকজনের সঙ্গে আমরা পরিচয় আছে। সেই সুবাদে তিনি আমাদের এক নামে ছোট ভাইয়ের মত ডাকতেন। তার প্রতি আমি ব্যক্তিগতভাবে অসীম শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং আমি প্রার্থনা করি তিনি ওপারে যেখানে তিনি গেছেন, সেখানে মহান সৃষ্টিকর্তা তাকে শান্তিতে রাখবেন।।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে তার অসাধারণ ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণ ও পরিচালনা এবং পরবর্তীতে সাধারণ মানুষ যাতে চিকিৎসা সেবা পায়, সেজন্য তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। স্বাস্থ্যনীতি যেটা করতে চেয়েছিলেন, সেটা করতে পারেননি। সেটা করতে পারলে বাংলাদেশের সাধারণ স্বাস্থ্য সেবা পেতে পারত।’

প্রয়াত চিকিৎসক ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারকে ‘সাহসী, দেশপ্রেমিক, সৎ এবং নির্ভীক’ হিসেবে বর্ণনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন। দেশের জন্য মানুষের জন্য কথা বলতে তিনি কখনও পিছপা হননি। এই রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে একটি জনগণের রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, এই সমাজকে সাধারণ মানুষের জন্য একটা সমাজ নির্মাণ করার জন্যে সারাটা জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন। তার এই চলে যাওয়া আমাদের যে অপূরনীয় ক্ষতি ও শূন্যতা সৃষ্টি হল, সেটা আর পুরণ হওয়ার নয়।’

বিএনপি মহাসচিবের সাথে আবদুল মঈন খান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, এজেডএম জাহিদ হোসেন, আবদুস সালাম, খায়রুল কবির খোকন, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘মানুষ হিসেবে তার গুণাবলী ছিল অনন্য। বলতে পারেন যে, মুক্তিযুদ্ধে সত্যিকার অর্থে জনযোদ্ধা ছিলেন তিনি। যুদ্ধের পরও তিনি মুক্তিযুদ্ধকে চালিয়ে গেছেন। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন।’
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি।

১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা নিতে জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুক্তরাজ্যে গেলেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পড়াশোনা বাদ রেখে দেশের টানে ছুটে আসেন।

লন্ডন থেকে ফিরে ভারতের আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রথমে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন জাফরুল্লাহ। পরে সেখানেই ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭৯ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষা কমিটির ও নারী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮২ সালে প্রণীত জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে অবদান রাখেন তিনি।

১৯৭৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসাবে পরিচিত ‘র‌্যামন ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার তিনি পান ১৯৮৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি ইউনিভার্সিটি ২০০২ সালে তাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ হিসেবে সম্মাননা দেয়।

খুবই সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী; কোনো দলে যুক্ত না হলেও রাজনীতি সচেতন এই ব্যক্তি বলতেন- ‘আমি মানুষের রাজনীতি করি।’