সুভাষ দে »
‘মুজিববর্ষ’ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানের মূল পর্বে ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন। বাংলাদেশে তাঁর এই সফর ছিলো ২ দিনের। কোভিড-১৯ এর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশে এলেন। শুধু নরেন্দ্র মোদিই নন, ১৬ মার্চ থেকে ১০ দিনের এই রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহ, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষ, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভা-ারী, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং। আমাদের প্রতিবেশি এই দেশসমূহের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্বের প্রশংসা করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তেমনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে যে ‘বিস্ময়কর’ আখ্যান রচিত হয়েছে তারও ভূয়সী প্রশংসা করেন দক্ষিণ এশিয়ার এই শীর্ষ নেতারা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নতুন মাত্রা যোগ তরেছে, কেননা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সকল প্রকার সহযোগিতা দিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাহসী যোদ্ধা ও জনগণকে স্বল্প সময়ে বিজয় লাভে সাহায্য করেছিলো। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক দু দেশের বহু মানুষের রক্তের বন্ধনের ওপর প্রতিষ্ঠিত, স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের যে ভিত রচিত হয়েছে বিগত এক যুগে তা মৈত্রী ও সহযোগিতার নতুন স্তরে উন্নীত হয়েছে। ভারত সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কারে’ ভূষিত করায় আমাদের আয়োজন আরো মহিমান্বিত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার হাতে এই সম্মাননা অর্পণ করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে।
নরেন্দ্র মোদির সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনায় দুই দেশের মধ্যেকার অমীমাংসিত বিষয় উঠে এসেছে তবে এবার কানেকটিভিটি, তথ্য প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, করোনা প্রতিরোধে দু দেশের সহযোগিতা ছাড়াও অর্থনৈতিক বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে ভারত যুক্ত থাকতে চায় বলে জানিয়েছে। (সূত্র : প্রথম আলো ৩১ মার্চ’২০২১)
আমাদের দেশের গণমাধ্যমে দুই প্রধান মন্ত্রীর আলোচনার বিশদ বিবরণ নানাভাবে উঠে এসেছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকে অর্থনৈতিক ও কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে যৌথ সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটাসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যৌথ সহযোগিতা বিস্তৃত করার বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনা হয়েছে (দৈনিক সমকাল ২৮ মার্চ’ ২০২১)।
কানেকটিভি বা সংযুক্তি দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনায় বিশেষ স্থান পেয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সড়ক রেল নৌ যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ সার্ক, বিমসটেক ও বিবিআইএন জোটভুক্ত দেশগুলির মধ্যে আন্তঃ সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে দুই দেশ কাজ করতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে চায়। এ ব্যাপারে ভারত সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে। নেপালের সাথে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপনে ভারতীয় ভূখ- ব্যবহার করতে দিতে ভারত সম্মত হয়েছে। ভুটানের সাথেও অনুরূপ রেল যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় মহাসড়কে (ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার) যুক্ত হতে চায় বলে ভারতকে জানিয়েছে। বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল) মোটরযান চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে যাত্রী ও পণ্য চলাচল দ্রুত হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে ৫ সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে এবং ৮টি প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে ৩টি সীমান্ত হাট উদ্বোধন, চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন, মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক ইত্যাদি।
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর আলোচনা হয়েছে তবে এগুলির আশু সমাধান দু দেশের সম্পর্ক আরো বিকশিত ও গভীর করতে জরুরি। এগুলির হলো তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, ৬টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা রোহিঙ্গা ইস্যুটিও আলোচনায় এসেছে। তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব শ্রী হর্ষবর্দ্ধন শ্রিংলা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই সাথে অভিন্ন নদী পানি বণ্টন বিষয়ও এসেছে। তিনি দু দেশের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা ও তথ্য আদান প্রদান চলছে বলে জানান (সমকাল, ২৮ মার্চ)। কিন্তু কথা হলো, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ২০১১ সালে ঢাকা সফরকালেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা চূড়ান্ত হয়েছিল তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাগড়া দেওয়ায় চুক্তি করা সম্ভব হয়নি- তথ্য উপাত্ত কারিগরি সবদিক ফয়সালা হয়েই চুক্তি হতে যাচ্ছিল। এখন আবার তথ্য আদান প্রদানের কথা আসছে কেন? আর তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ তিস্তার পানি প্রয়োজনমতো পাচ্ছেনা বলেছেন, সে তো বাংলাদেশও পাচ্ছে না। এর মূল কারণ তিস্তার উজান থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পে পানি অন্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়া। এই মূল বিষয়টি আড়ালে পড়ে গেছে। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী, উজান এবং ভাটির দেশগুলির সমস্বার্থই বিবেচ্য, অন্য নদীগুলির ব্যাপারেও একই কথা। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুম তথা ত্রিপুরার মানুষের অকৃত্রিম সহযোগিতার কথা মনে রেখে সাব্রুমবাসীদের ফেনী নদী থেকে পানি দিয়েছে। মানবতা এবং জনগণের বাঁচামরার প্রশ্নে কূটনীতি কিংবা সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্য স্বার্থ প্রাধান্য পাওয়া উচিত নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দশক ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টিও বৈঠকে তুলে ধরেন।
সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা প্রসঙ্গে মানবতা এবং আন্তর্জাতিক বিধিবিধানকে গুরুত্ব দেয়া বাঞ্ছনীয়। এই ইস্যুটি বাংলাদেশের জনগণের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, দরিদ্র কিশোরী ফেলানির কাঁটাতারে ঝুলানো লাশ শুধু বাংলাদেশের জনগণকে নয় বিশ্ব বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বহু সীমান্তে ছোটখাট অপরাধ ঘটে, অবৈধ বাণিজ্য চলে, দু দেশের সীমান্ত রক্ষীরাও তা জানে। আমরা মনে করি দু দেশের সীমান্ত রক্ষী কর্মকর্তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এসব অপরাধ কমিয়ে আনতে কাজ করবেন। সীমান্তে হত্যা বন্ধে সীমান্ত হাট স্থাপন একটি উপযুক্ত পদক্ষেপ। এটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতীয় নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায় থেকে সীমান্তে হত্যা বন্ধে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আমরা আশাকরি, এই সদিচ্ছার প্রতিফলন আমরা সামনে দেখতে পাবো।
বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা ও একটি দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়। আমরা ভারত থেকে আমদানি বেশি করি, পক্ষান্তরে ভারতে আমাদের রপ্তানি খুবই কম। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) ভারতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১০৯ কোটি ডলার আর বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে ৫৭৯ কোটি ডলারের পণ্য। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতার মূলে রয়েছে ভারতের অশুল্ক এবং আধা শুল্কবাধা যদিও ভারতের পক্ষ থেকে ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক মনে করে এসব বাধা দূর হলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। (সূত্র : সমকাল ২৮ মার্চ ২০২১)
পাট পণ্যের ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। অথচ পোশাক এর পর এটি আমাদের বড় রপ্তানি আইটেম। পণ্যের মান যাচাইয়ে কালক্ষেপণ ও একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশের সাথে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়তে পারে যদি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে মনোযোগ দেয়।
আমরা মনে করি বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা দূর করতে আরো বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাও সহযোগিতামূলক ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা অবাধ বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) কথা বলছেন। বৃহৎ প্রতিবেশি এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় ভারত এ ব্যাপারে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিলে বাংলাদেশের লাভ হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এসেছে। ভারত রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে, প্রত্যাবাসনেও বাংলাদেশের সাথে কাজ করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে বড় বাধা তবে চীন, ভারত ও জাপানের মতো এশিয়ার বড় দেশগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যকর ভূমিকা নিলে প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে।
দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দু দেশের সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক ও বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে যা দু দেশের বর্তমান সম্পর্ক আরো গতিশীল ও নতুন উচ্চতার স্তরে পৌঁছুবে। এ ক্ষেত্রে সংযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি যেমন ইতিবাচক হয়েছে, অন্যান্য ইস্যুগুলি সমাধানে দু পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। অর্থনৈতিক নানা প্রকল্পের বাস্তবায়নে ভারতের সহযোগিতা ছাড়াও চিকিৎসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি তথ্যপ্রযুক্তি বিনিময়, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার দু দেশের জনগণকে নৈকট্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবে। নরেন্দ্র মোদির সফরের তাৎপর্য তাই বিরাট এবং বিবিধ।
লেখক : সাংবাদিক