শ্যামল বণিক অঞ্জন »
মুনিয়া দিন দিন যত বড় হচ্ছে মায়ের শূন্যতাটা ততই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শিখছে! মাঝে মাঝেই একা নীরবে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে। মায়ের ঘুমানোর বালিশটা বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে। কখনো কখনো আবার অলমারিতে রাখা মায়ের ব্যবহৃত শাড়িগুলোর গন্ধ শুঁকে মায়ের স্পর্শ নেবার চেষ্টা করে। ইদানিং প্রায়শই সকালে ঘুম থেকে ওঠে বাবাকে জিজ্ঞেস কওে, মা কবে আসবে বাবা? বাবা পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আসবে সোনা, খুব শীঘ্রই আসবে। তুমি এখন ফুপিকে গিয়ে বলো, ঝটপট রেডি করিয়ে দিতে। না হলে যে স্কুলের দেরি হয়ে যাবে! মুনিয়া তৈরি হয়ে এসে বাবার সাথে বেড়িয়ে পড়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে। স্কুলে যেতে যেতে রাস্তার দুপাশে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে মুনিয়া ওর মাকে খোঁজে। অপলক দৃষ্টিতে দেখে অনেক মায়েরা নিজ নিজ সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় চলছে আর এসব দেখে ছোট্ট মুনিয়ার বুকটা মায়ের জন্য হু হু করে ওঠে নিদারুণ শূন্যতায়! তবু আশায় থাকে অবুঝ হৃদয়Ñ মা একদিন ঠিকই আসবে এবং পরম স্নেহ-মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে, আগলে রাখবে! কিন্তু ছোট্ট মুনিয়া জানে না তার জীবনের চরম সত্যটা। জানে না যে, ওর মা আর কোনোদিনও ফিরবে না। মুনিয়ার মা মুনিয়ার জন্মের সময় মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মুনিয়াকে কখনো কেউ এ কথাটি বলেনি। মুনিয়ার জন্মের পর থেকেই ওর ফুপি ওকে মায়ের মতো যত্ন-আদরে বড় করে তুলছে।ফুপির সাথে কাটানো সময়গুলো মুনিয়ার দারুণ কাটে!
কিন্তু ইদানিং মুনিয়া কেমন যেন হয়ে গেছে, সারাক্ষণ মনমরা, বিষণ্ন হয়ে থাকে। পড়াশোনাতেও কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। ফুপি বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছে। আর তাই ফুপি মুনিয়াকে বললো, আচ্ছা মামনি, ধরো কয়েক দিনের জন্য যদি আমরা কোথাও বেড়াতে যাই, তাহলে কেমন হয়? মুনিয়া বললো, খুব মজা হবে ফুপি! তাহলে বাবাকে বলো না, প্লিজ!
ফুপি বললো, আচ্ছা ঠিক আছে আমি আজই বলবো।
রাতে মুনিয়ার বাবা বাড়ি ফেরার পরে মুনিয়া ওর ফুপি আর দাদি মিলে মুনিয়ার বাবাকে বললো ওদের বেড়াতে যাবার প্ল্যানটির কথা। সকলের কথাশুনে মুনিয়ার বাবা বললেন, এটা তো খুবই ভালো কথা। অবশ্যই আমরা বেড়াতে যাবো এবং সেটা এই সপ্তাহের মধ্যেই। বেড়ানোর কথা শুনে ভীষণ উল্লসিত হলো মুনিয়া। মনে মনে ভাবতে লাগলো এই সুযোগে সবার কাছে বায়না ধরে যদি একবার কোনোমতে মামনির সাথে দেখা করা যায় তাহলে যেভাবেই হোক মামনিকে বাড়ি ফিরিয়ে আনবোই। তাছাড়া অমাকে দেখলে কি না ফিরে মামনি থাকতে পারবে! মায়ের সাথে দেখা হলে কি করবে, কি বলবে এ রকম আরো অনেক কথা ভেবে ভেবে সারারাত কিছুতেই যেন ঘুমাতে পারলো না মুনিয়া! খুব সকাল-সকাল উঠে পড়লো মুনিয়া। সাথে সবাইকে ডেকে তুললো এবং ঝটপট রেডি হয়ে গেল।মুনিয়াকে উল্লসিত দেখে বাড়ির সকলেই খুব খুশি হলো, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
সকাল সকাল ওরা বেড়িয়ে পড়লো। কুয়াশার চাদর ভেদ করে এগিয়ে চললো গাড়ি। যেতে যেতে হঠাৎ মুনিয়া বলে উঠল, আচ্ছা ফুপি আমরা তো বেড়াতেই যাচ্ছি তাহলে চলো না মামনির কাছে যাই! সবাই মিলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মামনির রাগ ভাঙিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে যাই। তাহলে ভীষণ মজা হবে! মুনিয়ার মুখে আচমকা এমন কথা শুনে সকলেই হতভম্ব হয়ে গেলো। চুপ করে রইলো। মুনিয়া আবারো বললো, কী হলো ফুপি, বাবা কিছু বললে না তো!
চলো না বাবা! প্লিজ! প্লিজ!!!
মুনিয়ার বায়নাটা ক্রমশই যেন জেদে পরিণত হতে লাগলো!
অবস্থা খারাপ দেখে দাদিমা বললেন, ঠিক আছে দাদু, আমরা না হয় ফেরার সময় যাবো।
দাদিমার কাছে আশ্বাস পেয়ে কিছুটা শান্ত হলো মুনিয়া। গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তার দুপাশে নানান রকম কিছু দেখতে দেখতে ফুপির কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো মুনিয়া। এবার দাদিমা বললেন, আমার মনে হয়, আমরা শামীমার মৃত্যুর কথাটি মুনিয়ার কাছে গোপন রেখে খুব বড় একটা ভুল করতে যাচ্ছি। এবার সব কথা ওকে জানানো উচিত। মুনিয়ার ফুপিও বললো, আমারও তাই মনে হয় ভাইয়া।
মুনিয়ার বাবা কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলেন। টানা এক সপ্তাহের ভ্রমণ শেষে এবার বাড়ি ফেরার পালা আর মুনিয়ারও প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হবার পালা।
মুনিয়া দাদিমাকে বললো, দাদিমা আমরা কখন যাবো মামনির কাছে?
দাদিমা বললেন, যাবো, দাদু একটু ধৈর্য ধরো। বলতে বলতে চোখের পানি মুছতে লাগলেন। মুনিয়া জানতে চাইলো, দাদিমা তুমি কাঁদছো কেন? দাদিমা বললেন, এমনিতেই। গাড়ি এগিয়ে চললো দ্রুতগতিতে। মুনিয়া বললো, আর কতোক্ষণ লগবে বাবা? বাবা অস্ফুটস্বরে বললেন, এই তো প্রায় এসে গেছি, মা।
সকলের বুকটা ধড়ফড় করে কাঁপতে লাগলো। হাত-পা থেকে সমস্ত শরীর যেন শীতল হবার উপক্রম। সকলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। অবশেষে গাড়ি এসে থামলো মুনিয়াদের গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানের সামনে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো আর মুমিয়া বলতে লাগলো, এটা কোথায় এলাম আমরা? ও বাবা! বলো না! দাদিমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। মুনিয়ার মায়ের কবরটা দেখিয়ে বললেন, অই যে, অইখানে ঘুমিয়ে আছে তোমার মা!
ছোট্ট মুনিয়া দাদিমার কথা কিছু বুঝতে পারলো না। তাই ওর সব থেকে বড় ভরসার স্থল ফুপিকে জিজ্ঞেস করলো, ফুপি ও ফুপি তুমি বলো না এখানে আমার মা কোত্থেকে আসবে? ফুপি মুনিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো আর বললো, হ্যাঁরে মা, তোর মামনি যে চিরদিনের জন্য এখানেই ঘুমিয়ে আছে। বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
তোর মামনি আর বেঁচে নেই সোনা!
ছোট্ট মুনিয়া যেন মুহূর্তে পাথরে পরিণত হলো! বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চারপাশে অন্ধকার অনুভব করলো। নিদারুণ শূন্যতায় ঢেকে গেলো যেন মুনিয়ার জগতটা।