‘মানুষখেকো’দের সঙ্গে বাঙালি সৈনিকের অন্যরকম অভিযান

হাফিজ রশিদ খান :

আফ্রিকা মহাদেশের এক বিস্তৃত-বিশাল দেশ কঙ্গো। বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনে ১৮ গুণ বড় দেশটি। ‘ওরিয়েন্টাল’ কঙ্গোর একটি পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ। এটির সঙ্গে রয়েছে সুদান, উগান্ডা, রুয়ান্ডা আর বরুন্ডিন সীমান্ত সম্পর্ক। এই অঞ্চলটি পৃথিবীর এক ভয়াবহতম মানবহত্যার অঞ্চলরূপে পরিচিত হয়ে ওঠে চলতি শতকের মধ্য শূন্যের দশকে। এ সময়ে এখানে আন্তগোত্রীয় সংঘাতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের জীবনহানি ঘটে। লেন্দু ও হেমা নামক দুই উপজাতি গোষ্ঠী পরস্পরের ওপর প্রধান্য বিস্তারের জন্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মেতে ওঠে এখানে। এদের মধ্যে লেন্দুদের বলা হয় ‘মানুষখেকো’। ওদের বিশ্বাস, শত্রুকে খেতে পারলে তার বাকি বয়স ও শক্তি খেকোদের শরীরে প্রবিষ্ট হয়। এই গোত্রীয় সংঘাতের পেছনে প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পন্ন ওই অঞ্চলের ওপর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লোলুপ দৃষ্টিও অন্যতম বড় কারণ ছিল। এই ওরিয়েন্টাল প্রদেশেই রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম সোনার খনি ‘মংবালু’। সোনার খনিটি  লুণ্ঠনের অভিপ্রায়ে বহুজাতিকেরাই উসকে দেয় সেখানকার গোত্রীয় সংঘাত ও সহিংসতা। এছাড়া আদিকাল থেকেই লেন্দু ও হেমাদের মধ্যে গোত্রপ্রাধান্যের বিবাদ তো ছিলই। প্রায় ছয় হাজার যোদ্ধার সমন্বয়ে লেন্দুরা যে-দুর্ধর্ষ গেরিলাবাহিনী গড়ে তোলে তার প্রধানের নাম পিটার করিম। গোত্রীয় নাম তাঁর উদাগা করিম হলেও বিখ্যাত রাশিয়ান জেনারেল পিটার দ্য গ্রেটের নাম থেকে করিম তাঁর নামের আগে পিটার শব্দটি বসিয়ে নেন।

এই ভয়াবহ গোত্রীয় সংঘাত দমন ও তাদের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিশেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম কঙ্গো গমন করেন ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে। সেই রোমহর্ষক ঘটনাবলির সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্তি ও দূতিয়ালি এবং অপূর্ব নৈপুণ্যে লেন্দু গেরিলাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সার্থক প্রচেষ্টার এক রুদ্ধশ্বাস স্মৃতিচারণ ‘নেপালি জিম্মিদের উদ্ধার অভিযান/ মানুষখেকোদেরর সঙ্গে জঙ্গলজীবন’ (২০২১) গ্রন্থটি।

অত্যন্ত সতর্ক, প্রশিক্ষিত ও দুর্দান্ত প্রকৃতির গেরিলা নেতা পিটার করিমের সঙ্গে লেখকের হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা, পিটারের গহন জঙ্গলের ক্যাম্পে একাকী গমন, তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সুকৌশলে শান্তির বাতাবরণে প্রভাবিত করে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার ঘটনা সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর ও চিত্তাকর্ষক। পিটার করিম বিষয়ে লেখকের পর্যবেক্ষণ : ‘স্থানীয় নেতাদের মধ্যে আমি একটা জিনিস লক্ষ করি তা হলো, পিটার করিম নামটা উচ্চারিত হতেই তাঁদের মধ্যে কেমন জানি একধরনের ভীতির উদ্রেক হয়। এই ভীতির উদ্রেক হওয়া অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ ইনসার্জেন্টদের মনে কারও প্রতি সন্দেহ জাগলে তার আর রক্ষা নেই। নির্মম নিষ্ঠুরতায় তার মৃত্যু অবধারিত। … এ থেকে আমার এটুকু বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয়নি যে পিটার করিম ভয়ংকর এক ছায়ামূর্তি হয়ে তাদের পিছু পিছু হাঁটছে’ (পৃ. ৩২)।

এদিকে গেরিলা কমান্ডার পিটারকে গ্রেফতার করতে পূর্ব ওরিয়েন্টাল প্রদেশের রাজধানী ইথুরির ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুব হায়দার খান (বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তা) তাঁর অধীন নেপালি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ঝংকারকে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। ব্রিগেড কমান্ডার তাঁর গোয়েন্দাসূত্রে জানতে পারেন যে পিটার করিম ২৭ মে (২০০৬) সন্ধ্যায় লানার কলিবা নামক গভীর জঙ্গলের একটি ডেরায় রাত্রিযাপন করবেন। এই অবস্থায় ওইদিন ভোররাতে নেপালি ব্যাটালিয়নের সৈন্যেরা যখন গভীর অন্ধকার ভেদ করে বিপদসংকুল অরণ্যপথ পাড়ি দিয়ে লক্ষবস্তুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল. তখন লেন্দু গেরিলাদের অতর্কিত প্রচ- প্রতিরোধের মুখে পড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এই অবস্থা থেকে নেপালি সৈন্যেরা ভারতীয় হেলিকপ্টার গানশিপের প্রচ- গোলাবর্ষণে নিরাপদে পশ্চাদপসরণে সক্ষম হলেও এই অভিযানে এক নেপালি সেনা নিহত হন এবং সাতজনকে তারা ধরে নিয়ে যায়। এই অবস্থায় মেজর (অব.) এমদাদ লেন্দুদের হাতে বন্দি নেপালি সাত সৈনিককে মুক্ত করতে সংকল্পবদ্ধ হন। জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি চার্লস গোমেজ তাঁর এই সংকল্পে সম্মতি দিলে শুরু হয় মেজর (অব.) এমদাদের অন্যরকম এক অভিযান। তবে সেটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নয়, অস্ত্র ও গোলাবারুদের ঝনঝনানি নয়, সবুজ অরণ্যের বুকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার লক্ষে ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টিও নয়। তাঁর এই অভিযানের লক্ষ ছিল সমঝোতামূলক আচরণকলার মাধ্যমে দুর্ধর্ষ গেরিলাদের শান্তির পতাকাতলে সমবেত করানো। আর জিম্মি নেপালি সেনাদের তাদের কবল থেকে সম্পূর্ণ জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তিচুক্তি, ১৯৯৭) সম্পাদনে চিফ সিকিউরিটি নেগোশিয়েটিং অফিসার হিশেবে দায়িত্ব পালনকারী এই বাঙালি সেনা কর্মকর্তা অত্যন্ত জীবনসংশয়পূর্ণ অভিযানে অদ্ভুত রকমের বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। সুচিন্তিত, সম্ভ্রান্ত সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় একক বুদ্ধিমত্তার দৌলতে তিনি পৌঁছে যান সেই বিন্দুতে যেখানে মানবতা বেঁচে থাকে তার সমস্ত বৈচিত্র্য নিয়ে, নানা কৌণিক বাস্তবতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আপাত বিরোধ সত্ত্বেও জীবনের গান হয়ে। মেজর (অব.) এমদাদ এখানে কুশলি কূটনীতিকের সকল উপায় ও উপকরণের ব্যাপক ও অব্যর্থ সদ্ব্যবহার করেছেন। প্রচ- অসহিষ্ণু, রক্তলোলুপ গেরিলাদের নেতা পিটার করিমের মনের তলদেশের সুকুমার বৃন্তে তিনি হাজির হয়েছেন ‘ওবাকাডো’র (আফ্রিকার এক মধুর ফলবান বৃক্ষের ফল) মতো। এক্ষেত্রে তিনি লেন্দুজাতির মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে সম্মানের অধিকারী ফাদার পাপা কোয়ানি, করিমের শ্যালক ওসমান, গেরিলা নেতা লরেন্ট, কর্নেল গাকপা, প্রতাপশালী গেরিলা কোবরা মাতাতা কোকাদুÑÑ এসব বিচিত্র মনোজাগতিক বৈশিষ্ট্যের মানুষগুলোকে কাছে টেনেছেন সংযত, মধুর ও আতিথ্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে। এর ফলে এসব কালো মানুষের সহায়তায় গেরিলা কমান্ডার পিটার করিমের সঙ্গে ধীরে গড়ে তোলেন বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য হার্দিক সম্পর্ক। এখানে একটি দৃশ্যের কথা উল্লেখ করি, যেখানে গহিন অরণ্যের ক্যাম্পে মুখোমুখি আলাপের বাসনায় লেখক চলেছেন একা। ভয়ংকর সব গেরিলাদের এলাকায়। ভয়-ডরহীন সৈনিক যেমন যায় সম্মুখ সমরে, তেমনি তিনি চলেছেন। লেখকের ভাষায় সেই সময়কার একচিলতে বিবরণ এ রকম : ‘প্রায় দুই কিলোমিটার চলার পর বড়সড় সশস্ত্র এক গেরিলাদল আমার গাড়ি থামায়। গাড়ি ঘিরে দাঁড়ায় তারা। আমি আমার ইউনিফর্মের হাতায় লাগানো বাংলাদেশের পতাকার ইনসিগনিয়া বা ছোট সংস্করণ দেখাই। পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ওরা হাসে। সশস্ত্র গেরিলাদের মুখে হাসি বেমানান, তাদের মুখে কদাচিৎ হাসি দেখা যায়। কারণ, এরা মৃত্যুর কারবারি। কখনো মৃত্যু এদের তাড়া করে, আবার কখনো এরা মৃত্যুকে তাড়া করে। উভয় ক্ষেত্রেই কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয় এদের’ (পৃ. ১০৫)।

‘কোয়ান্ডোরোমা’ÑÑগভীর অরণ্যে আচ্ছাদিত এই স্থানেই ছিল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ছাউনি। লেখক এখানেই টানা ৪৫দিন অবস্থান করে তাঁর মিশন সফল করে তোলেন। কত নির্ঘুম রাত আর পদচারণায় কেটেছে তাঁর সেইদিনগুলো, সেই রাতগুলোতে। শুধু শংকা আর অস্থিরতার কথা নয়, একই সঙ্গে তাঁর সৌন্দর্যপিয়াসী ও অনুসন্ধিৎসু মন ও মননের পরিচয়ও এখানে ধ্রুবতারার মতো জেগে থাকে। কঙ্গোর ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক স্যেন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন, বেলজিয়ান ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির সংগ্রামে গত শতকের ষাটের দশকে মহান নেতা পেট্রিস লুমুম্বা’র নেতৃত্ব ও স্বাধীন কঙ্গো প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা যে-বর্বরতায় তাঁকে হত্যা করে তারও প্রাসঙ্গিক ইতিহাস অবতারণা করেছেন। সেই বর্ণনা  যেমন বেদনাপূর্ণ, তেমনি সাবলীল।

২০০৬ সালের মধ্য জুলাইয়ে পিটার করিম ও তাঁর গেরিলাদল স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে আর নেপালি জিম্মিরাও মুক্ত হন। কঙ্গোর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা এই বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিশেবে লেখককে বলেছিলেন, ‘আপনার প্রতি আমার এবং কঙ্গোলিজ জাতির অশেষ কৃতজ্ঞতা’। সেই কৃতজ্ঞতা আমরাও পোষণ করি এই সৈনিকের প্রতি। কারণ, আমাদের দেশের হয়ে একটি উচ্চমাত্রিক ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে যুক্ত থেকে তিনি সফল হয়েছেন সর্বতোভাবে।

বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা। মে ২০২১ সালে। প্রচ্ছদ : মাশুক হেলাল। মূল্য : ৩২০ টাকা।