অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ »
পবিত্র রমজানে নিরাপদ ও মানসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করা জরুরি। এ মাসে বড় উদ্বেগের কারণ খাদ্য দ্রব্যের মানের বিষয়টি। রমজানকে কেন্দ্র করে খাদ্যে ভেজালের ব্যাপকতা বেড়ে যায়। আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের পাঁচ মৌলিক অধিকারের মধ্যে একটি খাদ্যের অধিকার। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা এর মধ্যেই পড়ে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) এর মতে খাদ্য নিরাপত্তা হলো এমন একটি অবস্থা পৃথিবীর সব স্থানের সকল মানুষের সুস্বাস্থ্যে নিশ্চিন্তে পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় পছন্দের খাবার পাওয়ার দৈহিক ও আর্থিক সুযোগ সৃষ্টি করা। যে খাদ্যে কোনো ক্ষতিকারক কেমিকেলস নেই, জীবানু দ্বারা দুষ্ট নয়, প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ ও প্রাকৃতিকভাবে তৈরি সেটাই নিরাপদ খাবার।
সম্প্রতি খাদ্যের মানের বিষয় একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ছে ভেজালের ব্যাপকতা। মানুষ কেন খাদ্যে ভেজাল দেয় তার কারণ পর্যালোচনা করলে মানুষের ভোগী মনোবৃত্তির পরিচয় মেলে। স্বল্প সময়ে যাতে অধিকতর উপার্জন করা যায় সেদিকেই ভেজালকারীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে। এতে পরিশ্রম কম হয় কিন্তু রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠা যায়। স্বার্থান্ধ মানুষ নিজেদের স্বার্থের কথা মনে রেখে ভেজাল দিতে গিয়ে মানুষের যে চরম সর্বনাশ সাধন করে তা কখনই তারা ভেবে দেখে না। ভেজাল মিশ্রিত জিনিস খাওয়ার ফলে নানা প্রকার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার যথেষ্ট নিদর্শন সহজেই পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেসব রাসায়নিক পদার্থ নিরাপদ খাদ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তার অন্যতম ফরমালিন। এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে মূলত মানুষের মৃতদেহ সংরক্ষণসহ নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু দ্রুত পচন রোধে সহায়ক বিধায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ফরমালিনকে একরকম সহজ মুনাফার পদ্ধতি হিসেবে খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করছে। ফলমূল, শাকসবজি ও মাছ-মাংসে এর ব্যবহার যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বস্তুত বর্তমানে এর অপব্যবহারই হচ্ছে বেশি। জটিল প্রক্রিয়ায় তৈরি ফাস্টফুড, রাস্তার খোলা খাবার এবং অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্য তৈরি করছে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি। কিন্তু ভেজাল ও ক্ষতিকর খাদ্য মানুষের সুস্থতার বদলে অসুস্থতা ডেকে আনছে। সরকার ২০০৯ সালে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯’ এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ প্রণয়ন করেছে। নিরাপদ খাদ্য আইনে- মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা উহার উপাদান বা বস্তু, কীটনাশক বা বালাইনাশক, খাদ্যের রঞ্জক বা সুগন্ধি বা অন্য কোন বিষাক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়া সহায়ক কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভূক্তি অথবা উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ মজুদ, বিপণন বা বিক্রয় করলে অনূর্ধ্ব ৫ বছর কিন্তু অন্যূন চার বছর কারাদ- বা অনূর্ধ্ব ১০ লক্ষ টাকা অন্যূন পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। পুনরায় একই অপরাধ সংঘটন করলে ৫ বছর কারাদ- বা ২০ লক্ষ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-। এছাড়া খাদ্য নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন ছাড়া খাদ্যপণ্য বিপণন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত কাউকে দিয়ে খাদ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। ভেজাল বিরোধী তৎপরতা কিছুদিন লক্ষ্য করা গেলেও পরবর্তীতে তা অনেকটা ভাটা পড়ে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এ যেসব কার্যকলাপকে অপরাধ গণ্য করা হয়েছে তা হলো-আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও পণ্যে মোড়ক ব্যবহার না করা; মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করা, সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা; ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রি করা; ভেজাল পণ্য বা ঔষধ বিক্রি করা, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশ্রণ করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা; প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা; ওজনে কারচুপি করা, বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শন করা, পরিমাপে কারচুপি করা, দৈর্ঘ্য পরিমাপক কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা, পণ্যের নব প্রস্তুত বা উৎপাদন করা, মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ঔষধ বিক্রি করা, সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা এবং অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দিয়ে সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ঘটানো ইত্যাদি। ভোক্তা অধিকার আইন ও নিরাপদ খাদ্য আইন এর যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার এ অপরাধ কমিয়ে আসবে। পাশাপাশি দেশের প্রধান খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) কে আরো সতর্ক ও সক্রিয় হয়ে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। এর থেকে পরিত্রানের জন্য আমাদের সমাজিক ভাবেও নীতি-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর এর জন্য দরকার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা। পরিশেষ বলব ভেজাল প্রতিরোধে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবোধ। উৎপাদক, বিপণনকারী সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক