জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে মাতৃমৃত্যু কমার ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও তাতে ধারাবাহিকতার ছন্দপতন হচ্ছে। চলতি দশকের শুরুতে সন্তান জন্ম দিতে যাওয়া মায়ের মৃত্যু বেড়েছে। দেশে প্রতি লাখ জীবিত শিশু জন্মের বিপরীতে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৬৮। যদিও আগের বছরগুলোয় তা কমতে শুরু করেছিল। এর মূল কারণ হচ্ছে প্রসূতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অভাব। মাতৃমৃত্যুর পেছনে বাল্যবিবাহ, কিশোরী গর্ভধারণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ও প্রসব-পরবর্তী অব্যবস্থাপনা দায়ী করছেন তাঁরা। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কমেনি। দেশের প্রসূতিদের বড় একটি অংশ প্রসবপূর্ব সেবা (এএনসি) পরিপূর্ণভাবে পায় না। একইভাবে প্রসবপরবর্তী সেবায় (পিএনসি) মাতৃমৃত্যু কমানো যায়। প্রসবের পর ২৪ ঘণ্টায় এ সেবা দেয়া হয়। বাল্যবিবাহ ও কিশোর গর্ভধারণকে (১৫-১৯ বছর বয়সে গর্ভধারণ) মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান জন্ম দেয়া মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ১৯৮৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর মাতৃমৃত্যু ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ১৯৮৬ সালে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মের বিপরীতে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত ছিল ৬৪৮ জন। ২০০১ সালে এ অনুপাত ৩১৫ জনে নেমে এলেও ২০০২ সালে তা ৩৯১ জনে দাঁড়ায়। এরপর ২০০৬ সালে ৩৩৭ জন থাকলেও ২০০৭ সালে এসে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত ছিল ৩৫১ জন। এর পর প্রতি বছরই মাতৃমৃত্যুর অনুপাত কমতে থাকে। ১৯৮৬ সাল থেকে যে ক্রমধারা দেখানো হয়েছে তাতে ৩৬ বছরের ব্যবধানে মাতৃমৃত্যু ৭৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করেছে সরকারের এ প্রতিষ্ঠান।
মাতৃমৃত্যুর অনুপাত কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উন্নতি রয়েছে উল্লেখ করলেও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বলছে, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমানোর উন্নতির পথে এখনো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। এগুলো হলো-অতি অল্পবয়সী প্রসূতি মায়ের মাতৃসংক্রান্ত জটিলতা, বাল্যবিবাহ ও পরবর্তীকালে গর্ভধারণ।
বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-গর্ভকালীন জটিলতা, প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি। বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গর্ভকালীন জটিলতায় ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ, প্রসবকালীন জটিলতায় ২৯, প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণে ২১, গর্ভপাতের জটিলতায় ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ ও বাকিদের অন্যান্য কারণে মৃত্যু হয়। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিষয়ক জরিপে (২০২২) বলেছে, অন্তত ২৪ শতাংশ মাতৃমৃত্যু ঘটে প্রসবকালীন খিঁচুনিতে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মো. মাহমুদুর রহমান পত্রিকাকে প্রণিধানযোগ্য একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণে সবচেয়ে বেশি মাতৃমৃত্যু হচ্ছে। মাতৃমৃত্যুর জন্য শুধু প্রসবকালীন ও পরবর্তী সেবার ঘাটতিই দায়ী নয়। এর পেছনে সচেতনতার অভাব, গোঁড়ামি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, বাল্যবিবাহ দায়ী।’
আসলে এসব কারণে সমাজ তো পিছিয়ে যাচ্ছেই সেসঙ্গে বাড়ছে মাতৃমৃত্যুর হারও। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু কুসংস্কার, কূপম-ূকতা ও গোঁড়ামি সে অর্জনকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। এটা ঠেকাতে হলে এখনই সতর্ক হতে হবে এবং সে সঙ্গে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
এ মুহূর্তের সংবাদ