নিজাম সিদ্দিকী »
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ (১১ নভেম্বর) কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেল উদ্বোধন ও টার্মিনালের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। এরপরই টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হবে। আর এর মাধ্যমে দেশের শিল্প-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে।
এ সম্ভাবনার কথা জানাতে গিয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে পুরোদমে শুরু হবে মূল কাজ। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর পুরো দেশের অর্থনীতিতে গতি আনবে।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখন চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিবছর ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা লাভ করে। মাতারবাড়ী বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে ৯ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে। সেটি সাত-আট বছরের মধ্যে উঠে আসবে। প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয় হবে।
শিল্পায়নের সম্ভাবনা
বন্দর ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। ইতিমধ্যে মাতারবাড়ীকে ঘিরে এ অঞ্চলে শিল্পায়নের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইউরোপ আমেরিকায় সরাসরি তৈরি পোশাক রপ্তানি সহজ হবে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা কলম্বোর মতো বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানির প্রয়োজন পড়বে না। এতে সময় ও অর্থ খরচ কমবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে মতে, ২০২৬ সালে প্রথমিক পর্যায়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর প্রতিবছর দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের) পণ্য আনা যাবে। ২০৪১ সাল নাগাদ টার্গেট দাঁড়াবে ১ দশমিক ৪ থেকে ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন টিইইউএস পণ্য পরিবহন। এসময়ে সিঙ্গাপুর বা অন্য কোনো বন্দরের ওপর নির্ভর করতে হবে না।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে ৭০০ মিটারের দুটি জেটি হবে। একটি টার্মিনাল হবে। প্রতিটি জেটিতে ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ১৮ মিটার ড্রাফটের (গভীরতার) দুইটি জাহাজ ভিড়তে পারবে। ২০২৬ সালের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে দুই পাশে চারটি করে আরও আটটি জেটি হবে। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো বন্দরে এতটা গভীরতা নেই। এত বড় জাহাজ নোঙর করার সক্ষমতাও নেই বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে এখন সর্বোচ্চ ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার ড্রাফটের (গভীরতার) জাহাজ ভিড়তে পারে। সরাসরি কোনো বড় জাহাজ পণ্য খালাস করা সম্ভব হয় না। লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করে মূল জেটিতে নোঙর করাতে হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানিপণ্য পাঠাতে সিঙ্গাপুর কিংবা অন্য কোনো বন্দর ব্যবহার করতে হয়। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানির সময় ও ব্যয় দুটোই কমে যাবে। ২০২৬ সালে পুরোদমে এই সমুদ্রবন্দর চালু হলে বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয়ের ফলে বদলে যাবে গোটা দেশের অর্থনীতি।
কোথায় বসছে বন্দর টার্মিনাল
মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেলের শেষ প্রান্তে রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহারের দুইটি জেটি। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে প্রকল্পের সরঞ্জামবাহী জাহাজ ভেড়ানো হয়। জানা গেছে, এ পর্যন্ত ১২৩টি জাহাজে প্রকল্পের সরঞ্জাম ও কয়লা আনা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটির অদূরে ও সাগর উপকূল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে নির্মাণ করা হবে গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল।
শুরুর কথা
বাংলাদেশে প্রথম সমুদ্রবন্দর হওয়ার কথা ছিল কক্সবাজার জেলার সোনাদিয়া দ্বীপে। ২০১২ সালে সরকার সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ২০১৬ সালে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করার সময় নির্ধারিত হয়। এ বিষয়ে আলোচনা চলছিল চীনের সঙ্গে। ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময়ে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে নির্ধারিত সমঝোতা স্মারক সই হয়নি। এরপরই ভেস্তে যায় প্রকল্পটি। এরপর পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর আলোচনায় উঠে এলেও সরকার মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে।
প্রকল্প অনুমোদন
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে। বন্দর ও সংযোগ সড়কসহ এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। প্রকল্প খরচের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান। আর সরকার ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা ও চট্টগ্রাম বন্দর ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা জোগান দিচ্ছে।
বন্দর নির্মাণের কাজ করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ-চবক)। প্রাথমিকভাবে মাতারবাড়ী বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে পরিচালিত হবে। আর সংযোগ সড়কের কাজ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং সার্বিকভাবে কার্যক্রম তদারকি করছে জাইকা।
কাজের অগ্রগতি
একনেকে অনুমোদনের পর ২০২০ সালের জুলাই মাসে টার্মিনালের নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর দরপত্র প্রণয়ন করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। দরপত্রে পেন্টাওশেন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে যৌথভাবে দুটি প্রতিষ্ঠান একটি দরপত্র জমা দেয়। এই দরপত্র মূল্যায়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ক্রয় কমিটিতে অনুমোদনের পর ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি হবে। নির্বাচিত ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির পরই শুরু হবে নির্মাণকাজ।
এদিকে, সাগর থেকে টার্মিনাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার লম্বা চ্যানেল বা জাহাজ চলাচলের নৌপথ আগেই তৈরি করা হয়েছে। মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় এই নৌপথ খনন করে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিপিজিসিবিএল। গত ২০ সেপ্টেম্বর চ্যানেলটি বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।