নিলা চাকমা »
দাঁতের চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন গড়ে ২৫০-৩০০ জন রোগী আসেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিটে। সেখানে চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত চেয়ার আছে মাত্র ৪০টি। তারমধ্যে ৩৮টি চেয়ারই ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, দাঁতের পরীক্ষা ও চিকিৎসার বিভিন্ন সরঞ্জামের সংকট নিয়ে চলছে এ ইউনিটের সেবা কার্যক্রম। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীসহ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ।
সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের একটি ওয়ার্ডে এক চিকিৎসক দাঁড়িয়ে সেবা দিচ্ছেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘চেয়ারটি উঠানামা করা যায় না। আমার জন্য একটি চেয়ার রয়েছে। সেখানে বসলে রোগীর দাঁত দেখা সম্ভব নয়। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোমর ব্যথা শুরু হয়েছে। তারই পাশে আরেক চেয়ারে এক চিকিৎসক রোগীর দাঁত চেক করছেন, অন্যজন মোবাইল দিয়ে আলো দেখাচ্ছেন। কারণ সেই চেয়ারের বাল্ব নষ্ট। সার্জারির আরেক ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, এক রোগীর মুখে অনেক রক্ত জমেছে। সেই জমে থাকা রক্ত ফেলা হচ্ছে ময়লাযুক্ত বাটিতে। কারণ সেখানে কাজ করে না ওয়াটার সাকশন। ফলে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা।
সার্জারি থেকে আরও ভয়াবহ অবস্থা অর্থোডন্টিক্স বিভাগে। ঐ বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে এক চিকিৎসকের গলদঘর্ম অবস্থা। কারণ চিকিৎসকের পাশেই একটি চুলা। সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, সেই আগুনে দাঁতের মাড়ি প্রস্তত করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই চিকিৎসক জানান, এখানে ৩টি চেয়ারই ব্যবহার অযোগ্য। একই সাথে চুলার আগুন বাইরে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে এক অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে সেবা দিতে হচ্ছে।
দাঁত পরিষ্কার করতে এসেছেন সাতুন সাফিন। পতেঙ্গা থেকে সোমবার সকাল ৯টায় তিনি হাসপাতালে পৌঁছান। কিন্তু তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তিনি সিরিয়াল পাননি। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে অনেক টাকা চলে যায়। কিন্তু এখানে চিকিৎসা পেতে এত দেরি হয় তা জানতাম না। সব রোগীদের একই অবস্থা। পরিবেশটাও খুব অস্বাস্থ্যকর।’
জানা যায়, হাসপাতালের ছয়টি বিভাগে ৪০ টির মতো দাঁতের চেয়ার রয়েছে। তারমধ্যে শতভাগ ব্যবহার উপযুক্ত মাত্র দুটি চেয়ার আছে। বাকি ৩৮ টির মধ্যে কোনটা উঠানামা করা যায় না, কোনটার হ্যান্ডপিস, বাল্ব উপরে, স্টেইনলেস যন্ত্র ট্রে, ব্যাকরেস্ট (চিকিৎসকের বসার চেয়ার), ওয়াটার সাকশন অচল।
দীর্ঘ বছর ধরে ব্যবহার অনুপযোগী চেয়ার দিয়ে চলছে হাসপাতালটি। কেন নতুন চেয়ার আনা হচ্ছে না এই প্রসঙ্গে চমেকের ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. আকরাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান। পরে একই প্রসঙ্গে কথা হয় ওরাল ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আজম খানের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের দাঁতের কোনো না কোনো সমস্যা থাকে। বেসরকারি হাসপাতালে দাঁতের চিকিৎসায় মোটা অংকের টাকা খরচ হয়। তাই নি¤œবিত্ত রোগীরা বাধ্য হয়ে এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্ত চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিটি বিভাগকে। সব মিলিয়ে ৪০টি, তার মধ্যে ৩৮ টি চেয়ারের অবস্থা নড়বড়ে। ২০০৬ সালে কিছু নতুন চেয়ার আসে এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে দুটো চেয়ার যুক্ত হয়। এরপর থেকে আর কোনো চেয়ার আসেনি। নতুন আরও ২০ অত্যাধুনিক চেয়ারের জন্য চিঠি দিয়ে যাচ্ছি। কিন্ত কোনো সুরাহা হচ্ছে না। অথচ চেয়ার ভালো থাকলে সেবা দিতে আমাদের আরো সুবিধা হতো। রোগীরা বিনা ভোগান্তিতে চিকিৎসা সেবা নিতে পারতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত বছর পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই কাজ এখনো চলমান। তবে এখনো সবকিছু হাসপাতালের আওতায় রয়েছে।’
এ ব্যাপারে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ডেন্টাল ইউনিট হাসপাতালের অংশ নয়। তিনি বিষয়টি নিয়ে ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. আকরাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক আরো বলেন, ‘ডেন্টাল ইউনিট হাসপাতালের অংশ না হলেও আমরা বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করি। কিছুদিন আগেও এক্সরে মেশিন দিতে চেয়েছি। কিন্তু অপারেটর নেই বলে তারা সেটি গ্রহণ করেননি। তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দাঁতের চিকিৎসার কোনো সরঞ্জাম পেলে তাদের দিব।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) ডেন্টাল ইউনিট এবং ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর ৬০ জন শিক্ষার্থী বিডিএস কোর্সে ভর্তি হয়। বাংলাদেশে সকল ডেন্টাল কলেজ এবং ইউনিটের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে এটির অবস্থান। হাসপাতালে ছয়টি বিভাগ রয়েছে- ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি, কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি অ্যান্ড এন্ডোডন্টিকস (দাঁত পরিষ্কার করা) , প্রসথোডন্টিকস (দাঁত বানানো), চিলড্রেন বিভাগ, অর্থোডন্টিক্স বিভাগ, প্রিভেন্টিভ ডেন্টিস্ট। প্রতিদিন আউটডোরে ২৫০-৩০০ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাসপাতালে- দাঁত তোলা, মাইনর সার্জারি, মেজর অপারেশন (মুখে টিউমার, জিহব্বা বা তালুতে ঘা), ফিলিংসহ বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হয়। আছে ২০ শয্যার একটি ওয়ার্ড। যাদের মুখে টিউমার, জিহ্বা বা তালুতে ঘা হয় সেসব সিরিয়াস রোগীদের এখানে ভর্তি করানো হয়।