সাক্ষাৎকার : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান
চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান ৪০০ একর ভূমিতে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করলেও হালিশহর থেকে দক্ষিণ কাট্টলী পর্যন্ত ২৫০০ একর জমিতে অপারেশনাল কার্যক্রম হবে আগামীর বন্দর খ্যাত বে টার্মিনালের। বিদ্যমান বন্দরের প্রায় ছয় গুণ বেশি ভূমি নিয়ে সাগরপারে গড়ে উঠছে এই বে টার্মিনাল। কিন্তু আলোচনায় যতো এগিয়ে, বাস্তবায়নে ততো পিছিয়ে এই টার্মিনাল নির্মাণ। ২০১০ সালে আলোচনায় আসার পর এখন পর্যন্ত এর কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। এই প্রকল্পের শুরু থেকে এপর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে তিনজন চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে চতুর্থ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ। বে টার্মিনাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিকল্পনা ও অগ্রগতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন সুপ্রভাত বাংলাদেশের প্রধান প্রতিবেদক ভূঁইয়া নজরুল।
-
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে
-
ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ব্যবসাকেন্দ্রিক গাড়ি চলাচলের জন্য এক্সপ্রেস লাইন প্রয়োজন
সুপ্রভাত বাংলাদেশ : বে টার্মিনাল প্রকল্পের অগ্রগতি কতটা?
রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ : বে টার্মিনালের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তথা পরিপূর্ণ পরিকল্পনা দরকার। আমরা তা করার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছি। ৫টি প্রতিষ্ঠান সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল। এদের মধ্য থেকে মন্ত্রণালয় একটি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিলেই কাজ শুরু করবে।
সুপ্রভাত : ২০১০ সালে আলোচনায় আসা প্রকল্পটি এতো বছর পর এসে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ কেন?
এস এম আবুল কালাম আজাদ : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পূর্ববর্তী চেয়ারম্যান এডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদ স্যার সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার মাধ্যমে এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিরুপণ করেছিলেন। পরবর্তী চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল স্যার তা অব্যাহত রেখে এগিয়ে গেছেন। এরপর সেই প্রচেষ্টা তেমন এগোয়নি। তবে আমি দায়িত্ব নেয়ার পর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছি। যে স্থানে এই বে টার্মিনাল নির্মাণ হবে সেই স্থানের একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা থাকবে। ফিনান্সিয়াল ও টেকনিক্যাল বিষয়ের পাশাপাশি এর ফিজিবিলিটির দিকটিও গুরুত্ব দেয়া হবে। সর্বোপরি মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে ধাপে ধাপে নির্মিত হবে বে টার্মিনাল।
সুপ্রভাত : তাহলে কি মাস্টারপ্ল্যান না থাকার কারণে কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ডটি অনুমোদন পায়নি?
এস এম আবুল কালাম আজাদ: এটা তো স্বাভাবিক বিষয়। পুরো প্রকল্পের প্ল্যান ছাড়া খ-িতভাবে তো কিছু হতে পারে না। মন্ত্রণালয়ের কাছে কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের ডিপিপি পাঠানোর পর তারা পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে পুরো এলাকার ডিটেইলড প্ল্যান করতে বলেছে।
সুপ্রভাত: পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্টাডি করতে কতটা সময় লাগতে পারে?
এস এম আবুল কালাম আজাদ : আট থেকে নয় মাস লাগবে বে টার্মিনাল নিয়ে স্টাডি করতে। যদি আগামী মাসেও আমরা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করি তাহলে তারা ২০২১ সালের শেষের দিকে রিপোর্ট জমা দেবে। সেই রিপোর্টে উঠে আসবে কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড, ব্রেক ওয়াটার, চ্যানেল, টার্মিনাল নির্মাণসহ বে টার্মিনালের সবকিছু। আর এর ভিত্তিতে সরকার টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্ব কাকে দেবে তা নির্ধারণ করবে। তবে ধারণা করা যাচ্ছে ২০২১ সালের শেষে টার্মিনাল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করা যাবে।
সুপ্রভাত: টার্মিনাল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার পর কবে নাগাদ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং শুরু করা যেতে পারে?
এস এম আবুল কালাম আজাদ : সহজ যাতায়াত সুবিধা বিদ্যমান থাকায় এই জায়গায় টার্মিনাল নির্মাণে তিন থেকে চার বছরের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সেই হিসেবে হয়তো ২০২৬ সালে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
সুপ্রভাত : টার্মিনাল নির্মাণে পিএসএ (পোর্ট অব সিঙ্গাপুর) কিংবা সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানির নাম শুনা যাচ্ছে। এসবের সত্যতা কতটুকু।
এস এম আবুল কালাম আজাদ : আমি আগেই বলেছি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে বে টার্মিনালের পুরো প্ল্যান না করানো পর্যন্ত এবিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই। আর আমরা এটি নির্মাণে যেহেতু দাতা সংস্থার সাপোর্ট নেবো তাই কোন অংশে কি সাপোর্ট নেবো তা পরবর্তীতে বিবেচ্য বিষয়। যেমন- ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল আমাদেরকে ( চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ) নির্মাণ করে দিতে হবে। তা নির্মাণ করতে যে খরচ হবে সেজন্য সরকারের মাধ্যমে আমরা কোনো দাতা সংস্থা বা দেশ থেকে সাহায্য নিতে পারি। আর টার্মিনাল নির্মাণে সরকার সিদ্ধান্ত দেবে। এখন অনেক দাতা সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের কোম্পানি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এটা স্বাভাবিক বিষয়।
সুপ্রভাত: বে টার্মিনালের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
এস এম আবুল কালাম আজাদ : সাগরপারের পাশে রেল ও সড়কপথ থাকায় বে টার্মিনালের উপযোগিতা খুবই আশাব্যাঞ্জক। এখন এই সড়কের সাথে মিরসরাই ইকোনমিক জোনের সংযোগ হয়ে যাচ্ছে প্রস্তাবিত উপকূলীয় সড়কের মাধ্যমে। অপরদিকে টানেলের মাধ্যমে কক্সবাজার পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সব মিলিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে বে টার্মিনাল। এটি চালু হলে নগরের ওপর ব্যবসা-বাণিজ্য-কেন্দ্রিক ট্রাফিকের চাপ কমবে। বে টার্মিনালের আশপাশে অনেক খালি জায়গা রয়েছে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থাপনা গড়ে উঠবে।
এছাড়া ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য পৃথক লেন (সড়ক ও রেলপথে) দরকার। এজন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি এক্সপ্রেস লাইন করা প্রয়োজন। যা দিয়ে শুধু ব্যবসা সংক্রান্ত গাড়িগুলো চলাচল করবে। এই সুবিধা কক্সবাজার পর্যন্ত বর্ধিত করতে হবে। কারণ ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ব্যাপক হারে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, তাই এসবের জন্য এক্সপ্রেস লাইন প্রয়োজন। অন্যথায় পণ্য পরিবহনে যেমন বিলম্ব হবে তেমনি জনভোগান্তিও বাড়বে।
সুপ্রভাত : বে টার্মিনাল হলে বিদ্যমান বন্দর লাইটার (ছোটো জাহাজ) বন্দর হিসেবে রূপ নিতে পারে বলে অনেকের ধারণা। আপনি কী মনে করছেন?
এস এম আবুল কালাম আজাদ : মোটেও না। বে টার্মিনাল হলে চট্টগ্রাম বন্দরে আসার ক্ষেত্রে বৈচিত্র আসবে। যেমন- কম ড্রাফটের ছোটো জাহাজগুলো বিদ্যমান জেটিতে ভিড়বে। এর চেয়ে বেশি ড্রাফটের বড় জাহাজগুলো বে টার্মিনালে এবং সবচেয়ে বড় আকারের জাহাজগুলো মাতারবাড়িতে ভিড়বে। এতে নৌ-পথে ফিডার রোডের প্রচলন বাড়বে। কলম্বো বা সিঙ্গাপুর পোর্ট থেকে অনেক জাহাজ সরাসরি মাতারবাড়ি বা বে টার্মিনালে দ্রুত পণ্য পাঠাতে পারবে। এখন ড্রাফট কম হওয়ায় বিদ্যমান জেটিতে এসব জাহাজগুলো আসতে পারে না। তাই বে টার্মিনাল হলে বিদ্যমান পোর্ট কোনোভাবেই লাইটারেজ পোর্ট হবে না। এটি আরো সুন্দরভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
সুপ্রভাত : বর্তমানে বহিঃনোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে ছোটো জাহাজে বাল্ক পণ্য পরিবহন করা হয়। বে টার্মিনাল হলে কি শিপ হ্যান্ডেলিংয়ের এই কার্যক্রম কমে আসবে?
এস এম আবুল কালাম আজাদ : বহি:নোঙ্গরে এখন যে কাজ হয় আগামীতে তা আরো আধুনিক হবে। তখন বড় জাহাজগুলো জেটিতে পণ্য নিয়ে জেটিতে ভিড়তে পারবে। আর এতে জেটিতে বড় ও লাইটার উভয় জাহাজে পণ্য আনলোড করার সুযোগ থাকবে। ফলে নৌ-পথে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পণ্য নিয়ে সরাসরি চলে যেতে পারবে।
সুপ্রভাত : কনটেইনার ডেলিভারি নিতে আসা ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যানের বিষয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
এস এম আবুল কালাম আজাদ : আমরা বে টার্মিনালের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ করছি। একইসাথে ওই এলাকায় একটি ট্রাক টার্মিনালও করবো। সেই টার্মিনালে চালকদের বিশ্রামের সুযোগ থাকবে। এখন যেমন পুরো নগরে ব্যবসা-বাণিজ্যের গাড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আগামীতে আর তা থাকবে না।
সুপ্রভাত : বে টার্মিনাল ঘিরে আরো কিছু করার কি ভাবনা রয়েছে?
এস এম আবুল কালাম আজাদ : বে টার্মিনালের বিদ্যমান জায়গার উত্তরপ্রান্তে কাট্টলী অংশে কিছু জায়গা রয়েছে। সেখানে একটি ওভারফ্লো ইয়ার্ড করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সুপ্রভাত : আপনি বললেন বে টার্মিনাল অপারেশনে আসতে পারে ২০২৬ সালে। মাতারবাড়িও আসবে ২০২৬ সালে। কিন্তু আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় আগামী পাঁচ–ছয় বছর বন্দরকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন কীভাবে?
এস এম আবুল কালাম আজাদ : এই সময়ের জন্য আমরা পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বাস্তবায়ন করছি। বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ি বন্দর অপারেশনে আসার আগে বিদ্যমান বন্দরের জেটির পাশাপাশি পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল সাপোর্ট দেবে।