জুয়েল আশরাফ
বৃষ্টি হচ্ছে। প্রসূতির যন্ত্রণার মতো বৃষ্টি। হাশমতের চোখে শিকারি বিড়ালের মতো সতর্কতা, দ্রুততা। তিনি হতবাক। তার হাতে একটি ধাতব লাঠি। একটি সুন্দর প¬াস্টিকের হাতানো ছাতা। তার কাছে এমন একটি ছাতা থাকা কাকতালীয় ব্যাপার। ছাতার কাপড়টি মূল্যবান, মসৃণ আর শক্তিশালী। কিন্তু আগ্রহের যে হাতে তিনি ছাতাটি ধরে রেখেছেন তা আনাড়ি , দেখতে কুৎসিত লাগছে। হাতটি ধরে রাখার চেষ্টায় অবিরাম কাঁপছে।
সারাটা পথ ধরে হাশমত ভাবলেন ছাতা নিয়ে ঘরে ঢুকলে সাহিরার মুখোমুখি হবেন। বাড়ির উঠানে পা রাখার সাথে সাথে গভীর বিস্ময়ে সাহিরার মুখ দেখতে পেলেন। হাশমত হঠাৎ হোঁচট খেয়ে কাশি শুরু করলেন। সাহিরা ভিজে-ভিজে চুপচাপ রান্নাঘরে চুলা ফুঁকছে।
আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গুঁড়ি- গুঁড়ি বৃষ্টি। মনে হচ্ছে সূঁচগুলো বৃষ্টি হতে শুরু করেছে, শরীরে বিঁধে যাচ্ছে। ঠান্ডায় কাঁপছেন হাশমত। কিন্তু এতটাই স্তব্ধ হয়ে গেলেন যে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। বৃষ্টি এড়াতে ঘরে প্রবেশ করবেন নাকি মাথায় ছাতা নিয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে থাকবেন? মাথায় ছাতা থাকলেও বৃষ্টির মধ্যে তাকে এই দৃশ্যে দেখলে বাড়ির মানুষের হুঁশ উড়ে যাবে।
গত বারোবছর ধরে হাশমত ছাতা কেনার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যেন বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে একজন সম্মানিত মানুষের মতো হাঁটতে পারেন। যুদ্ধ ও দরিদ্রজীবনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় একজন সম্মানিত মানুষ হওয়ার লোভ তার মনের মধ্যে কোথাও আটকে আছে। অনেক চেষ্টা ও তদবির করেও বারোবছরেও ছাতা কিনতে পারেননি। হাতের ছাতাটি চুি করে নিয়ে এসেছেন হাশমত।
তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রসূতির কুৎসিত যন্ত্রণার মত বৃষ্টি। কখনও কম, কখনও বেশি। একটা দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃিিষ্ট থামার অপেক্ষায় ঠান্ডায় কাঁপছিলেন হাশমত। যৌবনে তিনি কখনই বৃষ্টি-পানিকে পাত্তা দেননি। অপরাজিত যোদ্ধার মতো তার বুক ভেদ করতে পারেনি বৃষ্টি। কিন্তু যতই তিনি বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, ধমনির রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শীতের বৃষ্টিতে তিনি ক্রমশ ভয় পেয়ে যান। শীতের বৃষ্টিতে ভিজে তার হাত-পা প্রায়ই অসাড় হয়ে যায়। মাঝেমাঝে মনে হয় হৃৎপি- থেমে যাবে। তিনি মরতে চান না। জীবনের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ও অনুরাগ।
বৃষ্টি হচ্ছে, ঠিক তখন তার দৃষ্টি পড়ল ছাতার দিকে। দেয়ালের কোণে, হয়তো কেউ ভুলবশত রেখে গেছে। ছাতাটা দেখামাত্রই চোখ লাল হয়ে গেল তার। চোরের চোখে চারদিকে তাকালেন। কেউ তাকে দেখছিল না। ব্যস্ততা দেখিয়ে বারান্দায় ঘুরে, কাশতে-কাশতে ছাতার কাছে পৌঁছে গেলেন। আবার চোরের দৃিিষ্ট এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে নিলেন। তখনও কেউ তার দিকে তাকায়নি। অযতেœ ঝুঁকে পড়লেন, আর কম্পিত হৃদয়ে ছাতাটা তুলে নিলেন। তার চুরি করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু তার মধ্যে একটি অভাবী হাত আছে। তিনি ছাতাটি ধরলেন আর তুলে নিলেন। ছাতা মাথায় নিয়ে রাস্তায় নামলেন। অযতেœ হাঁটতে শুরু করলেন, কিন্তু তার মনে হল যেন বরফের মতো কিছু তার মেরুদ-ের নিচে গলে যাচ্ছে। বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখলেন।
আবার বৃষ্টি হল। হাতে একটি খোলা ছাতা। উঠানে দাঁড়িয়ে ঠান্ডায় কাঁপছেন হাশমত। তার প¬াস্টিকের জুতা কাদা এবং জলে ভরা। পা অসাড় হয়ে উঠছে। জানালার ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে বড় ছেলে তাকে দেখতে পেল। ছেলেটি বোর্ড পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠান্ড থেকে ছটফট করতে করতে পদার্থবিজ্ঞানের বই পড়ছে। বাবাকে দেখে বিস্ময় আর নীরবতায় ডুবে গেছে আনাস। এই বিস্ময় আর নীরবতা বাবার ভিজে যাওয়ার কারণে নয়, হাতে ছাতা দেখে। বারোবছরে এই প্রথম এমন ঘটনা। বাবাকে বৃষ্টিতে ভিজে কাজে যেতে দেখে প্রায়ই। ভেতরে-ভেতরে গলে যায় আনাস। ভাবে সে। সুযোগ পেলেই বাবার জন্য একটা ছাতা কিনবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বাবার হাতে ছাতা দেখে মনে হলো তাদের পরিবারটি যে গৌরবময় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তাতে ফাটল ধরেছে। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়বে।
অপরিসীম দুর্ভোগ আর অন্ধদারিদ্র্যের মুখে বাবা আনাসকে সৎউৎসাহ দিয়েছেন। বাবা এমন একটি শক্তি কখনও তাকে ভাঙতে দেয়নি। সে সাহসের সাথে বলতে পারে, সে এমন একজন পিতার সন্তান তার আদর্শের জন্য তার ভবিষ্যত বিসর্জন দিয়েছেন। বাবা আজীবন সত্য ও অহিংসার পথে চলার অঙ্গীকার করেছেন। ঘুষ না নেওয়ার কারণে সরকারি চাকরি ছেড়েছেন।
বাবার হাতে একটি মসৃণ আর শক্তিশালী ছাতা। একটি ধাতব লাঠি, সুন্দর প-াস্টিকের হাতল। নিশ্চিত যে বাবা অবশ্যই চুরি করেছেন। কারণ গত পনেরো বছরে বাবা এমন অবস্থানে ছিলেন না যে তার একটা সুন্দর ছাতা থাকবে। অথবা কিনতে পারবেন। আজকাল অবস্থা আরও নাজুক। তিন মাস ধরে বাবার কাছে চেয়ে সে ফি নিতে পারেনি। তাই ফি অর্ধেক মওকুফ করেছেন স্যার।
বাবার এহেন আচরণে আনাস আহত হয়। এখনও সে ছাত্র। স্বপ্নে সাঁতার কাটা আদর্শের প্রতি নিষ্পাপ সংযুক্তিপূর্ণ।
পদার্থবিজ্ঞানের বই বন্ধ করে চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়াল আনাস। যে-কাঠের চেয়ারটিতে সে বসে আছে এই চেয়ারে বাবা, কখনও-কখনও দাদাও বসে থাকতেন। এখন প্রচ- ঠান্ডা, অস্থির শীত অনুভব করল সে। তার ইচ্ছে হলো মাকে ডেকে একগ্লাস চা করে দিতে। কিন্তু পরের মুহূর্তে নিজেই স্তব্ধ হয়ে যায়। আর্থিক কারণে অসহায় মায়ের মুখ বিড়ালের চোয়ালে ইঁদুরের মতো ছটফট করছে তার চোখে। তারা এমন সুবিধার জীবনযাপন করছে না যে তাদের চায়ের চাহিদা ক্ষণে-ক্ষণে পূরণ হচ্ছে। সে আরও আতঙ্কিত হল যে, মা যদি জানতে পারে বাবা ছাতা চুরি করেছেন, তাহলে কী ভাববে?
সাহিরা কাঠ আর শুকনোপাতা দিয়ে চুলা জ্বালানোর চেষ্টায় আছেন। কাঠ ভেজা। জ্বলছে না। শুধু ধোঁয়া। রান্নাঘর ধোঁয়ায় ভরে গেল। শুধু রান্নাঘরই নয়, তিনি নিজেও ভেতরে ধোঁয়াধারণ করছেন। এক অদ্ভুত শিহরন ও অস্থিরতা অনুভব করছেন। এই লোকটি তার স্বামী। যখনই তিনি আঘাতপ্রাপ্ত পাখির মতো কাঁপতে-কাঁপতে বাড়ি এসেছেন সাহিরা বারবার বলেছেন, নিজের জন্য একটি ছাতা কিনুন। সাহিরা জানে, ছাতা কেনা হাশমতের বাজেটের বাইরে। পরিবারের মাত্র অল্প আয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রশ্নের বৃত্ত।
এই লোকটি যথেষ্ট শক্ত। তার বুক সমস্ত দারিদ্র্য এবং দুঃখকষ্টকে পান করেছে। এই তাপ থেকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বাঁচানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। অনেক দিন ক্ষুধার্ত থাকার পরও কারোর সামনে হাত পাতেননি। এই লোকটির আশ্চর্যজনক আত্মবিশ্বাস এবং সাহস। তিনজন নিষ্পাপ শিশু ওষুধ ও চিকিৎসা ছাড়াই মারা গেল। এই লোকটি তার বাহুতে দাফন করলেন। তার মুখে একটি কথাও ছিল না। হঠাৎ এই মানুষটা এত দূর্বল হয়ে গেল কিভাবে…? স্ত্রী হিসাবে কি তার কর্তব্য ছিল না এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে না দেওয়া যাতে এই ইস্পাতের মানুষটি ভেঙে পড়ে? এর জন্য কোথাও না-কোথাও তিনি নিজেই দায়ী। এতকাল লোকটির দুঃখ-দুর্দশা ও বঞ্চনার দিকে শুধু অগভীর দৃষ্টিতে দেখেছেন। শুধু সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। তার সহানুভূতি শক্তিশালী মানুষটিকে প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিয়েছে।
সাহিরা সারাজীবন কিছু না-করার জন্য হাশমতকে দোষারোপ করেছেন। বারবার তিনি বাড়ির জিনিসপত্রের অভাবকে তার সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, এই লোকটি তাদের সাথে লড়াই করতে-করতে নিজেকে মারতে থাকে।
চুলায় আগুন জ্বলেছে। আর বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। নদীর পাড়ে বিস্তৃত এই জীবনের কোনো এক সময়ে তাকে পাশে দাঁড়াতে হয়েছে। বঞ্চনার কালোচাদর ছিঁড়ে আন্তরিকতার সাথে, ভেঙে যাওয়া থেকে বাঁচাতে হয়েছে। কিন্তু তার নিজের আচরণ ক্রমশ শীতল বিরক্তি ও অবহেলায় পরিণত হয়েছে। এই লোকটির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাহিরা কেবল পরিবারের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি যদি কখনও নিজের কথা ভেবে থাকেন সে নিশ্চয়ই বলত তার লুঙ্গি ছিঁড়ে গেছে অথবা এরকম কিছু …। শুধু বুঝিয়েছে তার অনুরূপ কোনো অভাব নেই…।
এরই মধ্যে তার শারীরিক চাহিদার সাথে-সাথে ছাতাও হয়ে ওঠে মানসিক প্রয়োজন। পরিবারের বঞ্চনার শঙ্কা জাগিয়ে প্রতিবারই নির্মমভাবে এর চাহিদাকে পিষে দিয়েছেন তিনি। মাত্র চারদিন ক্ষুধার্ত থাকলে কি ছাতা কেনা যেত না? সর্বোপরি, বাড়ির অন্যান্য চাহিদাও কোনো না কোনোভাবে পূরণ হয়েছে।
পানি ফুটিয়ে সাহিরা গুড়পাতা ও দুধ মিশিয়ে চা তৈরি করলেন। কিন্তু তিনি দ্বিধায় পড়ে গেলেন, চায়ের জন্য হাশমতকে ডাকবেন কী করে? চা নিয়ে যাওয়ার সাহসও তিনি জোগাড় করতে পারছেন না। তিনি আতঙ্কিত। কীভাবে দুজন-দুজনের চোখাচোখি হতে পারবেন? লোকটি ছাতা চুরি করেছেন কিন্তু সাহিরার মনে হলো তিনি নিজেই ছাতাটি চুরি করেছেন।
বৃষ্টির তীব্রতা বেড়ে গেছে। হাশমত সম্পূর্ণ ভিজে গেলেন, তার হাতে একটি ছাতা থাকা সত্ত্বেও। শেষ পর্যনস্ত ছাতা ধরে বাইরের ঘরে প্রবেশ করলেন হাশমত। তিনি আতঙ্কিত এবং হতবাক হয়ে গেলেন। তার মনে হলো যেন তার নিজের ঘরে ঢুকতে চলেছেন, মেঝেতে পড়ে থাকা কুৎসিত জুতার ছাপ ধরা পড়বে …
প্রবল বর্ষণে টিনের ছাদ ফুঁসে উঠছে যত্রতত্র। শুধু বাইরে নয় বাড়িতেও তার একটা ছাতার দরকার ছিল। হাশমত হতাশ ও ক্লান্ত দৃষ্টিতে টিনের দিকে তাকালেন। তিনি অসহায় এবং আহত। বারো বছরে চারবার ঝড়ের মধ্যে ওড়ে েেগছেন। প্রতিবারই সেই একই হাত যা তাকে মারধর করেছে, তাকে কাঁচির ওপর বসিয়েছে, যে হাতে এই সময়ে চুরি করা ছাতা। তিনি জোরে কেঁপে উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে ছাতাটা খুঁটে ঝুলিয়ে দিলেন। খোঁপায় ঝুলে থাকা ছাতার সাথে বাঁধা স্রোতে জল গড়িয়ে পড়ে রুক্ষ মেঝেতে সাপের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছে। ছাতার ঘ্রাণে ঘর ভরে উঠল। বাড়ির সবচেয়ে মূল্যবান এবং সুন্দর জিনিস এই ছাতাটি।
পরের মুহূর্তে হাশমতের মনে হলো যে, বাইরের এই ঘরটি এতো মূল্যবান জিনিসের জন্য নিরাপদ জায়গা নয়। হাশমতের চোখ প্রথমে পড়ে খুঁটির ওপর। এক্ষুণি ধরা পড়বে। তিনি তৎক্ষণাৎ ছাতাটা খুলে ফেললেন আর ভাবতে লাগলেন, এটা কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়? এক অজানা ভয় তার ওপর আধিপত্য বিস্তার করছে। কোনো উপযুক্ত জায়গায় ছাতা লুকিয়ে সেই ভয় থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন। পরের চিন্তাটা তার মাথায় এলো যে, খাটের নিচে রাখা যেতে পারে। কিন্তু সেখানে ছাতাটি ইঁদুর কেটে ফেলতে পারে ভেবে সঙ্গে সঙ্গে তার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন।
হাশমত অনুসন্ধানী চোখে চারদিকে তাকাল। একটি বিশৃঙ্খল বড় টিন-টব ছড়িয়ে আছে। ওপরের ঢাকনা নেই। একটা আলমারি পুরানো বইয়ে ভরা। একটি কলসি, পাতা দিয়ে ভরা। অগ্নিশিখায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। সামান্য ধাক্কাতেই তার কলসি কেঁপে উঠল। এই ঘরটিতে বাতাসের জন্য একটি গ্রিল আছে, একটি কারাগারের মতো। গ্রিল দেখে দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটি দরজা, অর্ধেক পচে গেছে, দরজাকে বাঁচিয়ে রাখতে একটি টিনের পে¬ট দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। দেয়ালে ফাটল ধরেছে, স্যাঁতসেঁতে ছড়িয়ে পড়েছে। হাশমত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল- এই বাড়িতে কি এমন কিছু আছে, ছাতা রাখারও জায়গা নেই!
কিন্তু পরের মুহূর্তে দেয়াল স্পর্শ করা মাত্র পলেস্তার খসে যায়। হাশমত জীবনে একটি ইট কিনতে পারেননি। এই পৈতৃক বাড়ি পতিত দেয়াল তাকে আটকাতে পারেনি। তিনি চুপচাপ ছাতাটা দেয়ালের কোণে ঝুলয়ে রাখলেন, ট্রাঙ্কের পেছনে। উঠে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন কোণ থেকে পরিদর্শন করলেন। ছাতাটা ট্রােেঙ্কর আড়ালে লুকিয়ে রাখায় তিনি আশ্বস্ত হলেন। এটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গা। শুধু ইঁদুর আর উইপোকা থেকে রক্ষা করার জন্য কিছু যতœ নিতে হবে।
হাশমত নিশ্চিত হয়ে মাথা তুললেন, স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার দৃষ্টি দেয়ালে টাঙানো একটি পুরানো ক্যালেন্ডারে স্থির। বাঁশের পুলের আঁকা একটি ছবি, বাতাসে অস্থিরভাবে কাঁপছে। মনে হল তাকে চুলের মতো সরু চিকন পুল পার হতে বলছে।
পুলসিরাত একটি পারলৌকিক সেতু। পার না-হয়ে হাশরের ময়দান থেকে বেহেশতে যাওয়া যাবে না। কিয়ামাত হওয়ার পর সকল মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করে হাশরের ময়দানে সমবেত করা হবে। ইহলৌকিক জীবনের বিচার করা হবে। এই বিচারের পর হাশরের মাঠ থেকে পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতের দিকে যেতে হবে। হাশরের মাঠ থেকে বের হয়ে গন্তব্যে যেতে একটি পুল স্থাপন করা হবে। হাশরের ময়দান থেকে জাহান্নামের ওপর দিয়ে জান্নাত পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে এবং অনেক ভয়ঙ্কর হবে এটি। মানুষের আমলনামা ওজন এবং হিসাব-নিকাশের পর সবাইকে ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে পুলসিরাত দেখিয়ে দিয়ে বলবেন, ‘এটা তোমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ। এ পুল পেরিয়েই তোমাদের যেতে হবে।’ কিন্তু সবার জন্য পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। পাপী বান্দারা সেটাকে চুল থেকেও চিকন দেখতে পাবে। তাদের জন্য সেটি হবে অত্যন্ত ধারালো। তারা ওই পুলে আরোহণ করা মাত্রই তাদের পা কেটে নিম্নস্থ জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আর নেককারদের জন্য হবে সুপ্রশস্ত সুগম পথ। তারা তাদের নেকির তারতম্য অনুযায়ী গতিতে জান্নাতে পৌঁছে যাবে।
হৃদয়ের মধ্যে আঘাত পেলেন হাশমত। পরকালের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সারাজীবন তিনি মহৎ মানুষের ভূমিকা রাখতে চেয়েছেন। পারিবারিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি তা করতে না পারলেও সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন শুধু ঘুষ থেকে বাঁচার জন্য। সারাজীবন নিষ্ঠার সাথে মহামানবদের আদর্শ অনুসরণ করতে থাকেন। জীবনের দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে থাকেন। তাই বাধ্য হয়েছেন হৃদয়ের হাতে, নাকি ছিল আবেগপ্রবণ। আর এ কারণে তাকে বেদনা, অপমান ও অবহেলায় ভরা জীবনযাপন করতে হয়েছে। তার দুবেলা ভাতসমান সংখ্যক প্রশ্নে আটকে যেতে থাকে। এমনকি তিনি এতটাই বাধ্য হয়েছেন যে তাকে ছাতা চুরি করতে হয়েছে কারণ গত বারো বছরে নিরলস লড়াই করেও ছাতা কিনতে পারেননি।
ক্যালেন্ডার বাতাসে অস্থিরভাবে কাঁপছে। পুলের দৃশ্য দেখে হাশমতের ভেতরও কাঁপছে। তিনি গভীরভাবে অনুভব করলেন যে সেই সমস্ত আদর্শ তাদের রঙ হারিয়ে ইতিহাসের জিনিস হয়ে গেছে। কিন্তু এগুলো তার সম্পদ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির মূল্যবোধ। এগুলো ছাড়া তার আর কিছু বলার নেই। তাকে তার একমাত্র সম্পত্তি রক্ষা করা উচিত। কোনো অবস্থাতেই তাকে হারাতে দেওয়া উচিত নয়। সর্বাধিক পাপের মূল দুনিয়ার লোভ।
হাশমত অনুভব করলেন, তিনি শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। তার মধ্যে একটি অতিপ্রাকৃত চেতনা প্রবাহিত হচ্ছে। ট্রাঙ্কের কোণে লুকিয়ে রাখা ছাতাটা বের করলেন। তারপর আবার হৃদয়ে প্রশান্তির পানি ঢালতে লাগলেন। বাতাসের ঠান্ডা হাওয়ায় ভেতরের হাড়গুলো ফুলে উঠতে লাগল। শুধু হাতের ছাতাই তাকে পরকালের কঠিন অবস্থার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। হাশমত ছাতাটা শক্ত করে ধরলেন। দোকানে রেখে আসার মানসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।