রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন কাল
ফজলে এলাহী, রাঙামাটি
দীর্ঘ ১০ বছর পর রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আগামীকাল ২৪ মে। এর আগে ২০১৯ সালে সম্মেলনের সব প্রস্তুতি শেষ করার পরও সম্মেলনের পাঁচদিন আগে স্থগিত হওয়ার পর ফের দু’বছর পেরিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া এই সম্মেলনে সভাপতি ও সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন দুজন করে। ২৪৬ জন কাউন্সিলর ভোটেই সম্ভবত নির্ধারণ করবেন পরবর্তী নেতৃত্ব।
সভাপতি পদে লড়বেন ১৯৯৬ সাল থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করা বর্তমান সভাপতি ও সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান ও সহসভাপতি নিখিল কুমার চাকমা।
সাধারণ সম্পাদক পদে লড়বেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. মুছা এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী কামাল উদ্দিন।
সভাপতি পদে গত দুই দশকে প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়েছেন দীপংকর। সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর স্বাধীনতা যুদ্ধেও সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত প্রতিরোধ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ এই নেতা এক দশক ভারতে নির্বাসিত থাকার পর আশির দশকের মাঝামাঝিতে দেশে ফিরে আসেন এবং রাঙামাটি আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ১৯৯১ সালে তিনি নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন রাঙামাটি থেকে, এর আগে পার্বত্য এই জেলা থেকে আর কখনই বিজয়ী হয়নি নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। সেই থেকে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে তাকে ঘিরেই। এরপর অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। ২০০১ ও ২০১৪ সাল বাদে প্রতিবারই বিজয়ী হয়েছেন। রাঙামাটির আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয় এ নেতা, এই প্রথম চ্যালেঞ্জে পড়েছেন তারই সাবেক রাজনৈতিক শিষ্য নিখিল কুমার চাকমার।
তবে এ দুই নেতার দ্বৈরথ বেশ জমে উঠেছে এবার। মূলত নানা কারণে দীপংকর বিরোধী হয়ে উঠা জেলা, পৌর ও সদর উপজেলা কমিটির বেশ কিছু নেতা উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমাকে নিয়ে মাঠে নেমেছেন। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ায় গড়মিল, দলে তারুণ্যের হাওয়া বয়ে আনা, দীপংকরের কাছে মূল্যায়িত না হওয়ার অভিমানে ক্ষুব্ধ এসব নেতা ‘পরিবর্তন’ এর আওয়াজ তুলে মাঠে নেমেছেন। চেষ্টা করছেন সভাপতি পদে নিখিল আর সাধারণ সম্পাদক পদে হাজী কামালকে বিজয়ী করে তাদের প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দলের দায়িত্বে থাকার পাশাপাশি পার্বত্য এই জেলায় দলের ভিত সুসংহত করার মূল মানুষ দীপংকরকে পরাজিত করা ততটা সহজ নয়। জেলাশহর কেন্দ্রীক কিছু নেতা বাদে উপজেলা ও তৃণমূলে দীপংকরের যে শক্তিশালী অবস্থান, তাকে টলানো বেশ কঠিন বৈকি। তবে এবারই প্রথম বেশ চ্যালেঞ্জেই পড়েছেন তিনি।
বাঘাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বৃষ কেতু চাকমা বলছেন- ‘দীপংকর উড়ে এসে জুড়ে বসা কোন নেতা নন। এই পার্বত্য জনপদের সর্বত্র আজ আওয়ামী লীগের পতাকা যে উড়ছে এর কৃতিত্ব দীপংকরের। তার হাত ধরেই এই জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিকশিত হয়েছে, তৃণমূলে ছড়িয়েছে, শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়েছে। আজ জেলার যে কিছু নেতা ব্যক্তিস্বার্থে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারাও একসময়কার সুবিধাভোগী। অনেক কিছুই পেয়েছেন দীপংকরের কাছ থেকে। আরো বেশি পাওয়ার চাহিদা পূরণ না হওয়ায় এখন ‘তৃতীয় পক্ষ’র উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু তারা সফল হবেন না। তৃণমূল নেতাদের ভোটেই পুনর্নির্বাচিত হবেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা দীপংকর।’
সাবেক পৌর মেয়র ও কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান বলছেন, ‘সারাদেশের সাথে পার্বত্য রাজনীতির সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। এখানে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি আঞ্চলিক দলগুলোর অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হয় আওয়ামী লীগকে। সুতরাং আমাদের এমন নেতৃত্বই নির্বাচন করতে হবে, যারা পরীক্ষিত এবং এ লড়াইয়ে নিজেদের ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছেন। দীপংকর তালুকদার ও মুছা মাতব্বর সেই পরীক্ষায় বিজয়ী। যারা নিকট বা দূর অতীতে কখনই আঞ্চলিক দলগুলোর সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার সততাও দেখাতে পারেননি, সোচ্চার ছিলেন না মোটেও, আমরা কাউন্সিলররা তাদের বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় রাখব।’
সভাপতি পদে আরেক প্রার্থী নিখিল কুমার চাকমা নব্বইয়ের দশকে শেষার্ধে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। আওয়ামী লীগের এবারের প্রথম মেয়াদে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নিখিল বর্তমানেও জেলা আওয়ামী লীগের চার নম্বর সহসভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান। দলের নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয়তাও আছে তার।
সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন- ‘দলের কাউন্সিলর ও নেতাকর্মীদের অনুরোধেই আমি প্রার্থী হয়েছি। দীপংকর দাদা দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন,
আমি মনে করছি আমাকে নির্বাচিত করলে দলের কাজে আরো গতি আসবে এবং দলের নেতাকর্মীদের আরো বেশি সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে পারব। জয়ের ব্যাপারে ভীষণ আশাবাদি আমি।’
তবে নিখিল কুমার চাকমার পক্ষে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে অনেক নেতাই কাজ করছেন। তাদেরই একজন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জমিরউদ্দীন। তিনি বলছেন, আমাদের অবস্থান ব্যক্তি দীপংকরের বিরুদ্ধে নয়। সাংগঠনিক স্বার্থে দলকে আরো শক্তিশালী করতে পরিবর্তনের পক্ষে। দীপংকর তালুকদারকে কেন্দ্রে বড় দায়িত্ব দেয়া হক, আমরা নতুনদের সঙ্গে নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগকে আরো শক্তিশালী করতে চাই।’ তবে সাধারণ সম্পাদক প্রসঙ্গে নিজের কোন পক্ষ নেই বলে দাবি করেন জমির।
অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়া হাজী মুছা মাতব্বর ও হাজী কামালউদ্দিন দ্বৈরথ বেশ জমে উঠেছে। নিখিলকে নিয়ে যারা মাঠে নেমেছেন, তারা কামালেরও পৃষ্ঠপোষক শুরু থেকেই। কিন্তু দীপংকর ইস্যুতে মাঠে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় তাদের অনেকেই কৌশল পাল্টে দীপংকরের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সাধারণ সম্পাদক পদে চাইছেন কামালকেই। প্রভাবশালী এক প্রতিনিধি, একজন নারীনেত্রী এবং কিছু সহযোগী সংগঠনের নেতাকে একটি বলয়ে এনে দীপংকরের পক্ষে প্রচারণার আড়ালে কামালের প্রচারণায় বেশ সোচ্চার তারা। ফলে কদিন আগেই বেশ বেকায়দার থাকা কামাল, শেষ মুহূর্তে আগের চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থায় আছেন। কিন্তু মুছা করোনাকালীন মানুষের পাশে থেকে মানবিক কার্যক্রম, উপজেলার নেতাকর্মীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, দীপংকরের আশীর্বাদ থাকা এবং সবার সাথে নমনীয় আচরণের কারণে এই পদে পুনরায় শক্ত প্রার্থী। তার সাথে প্রার্থী হওয়া সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হাজী কামাল মূলত ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ। নব্বই দশকের শেষের দিকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া কামাল জেলা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ কাউন্সিলে ভোটের লড়াইয়ে হেরেছেন মুছার কাছেই। চার প্রার্থীর মধ্যে বয়সে সবচে সিনিয়র কামাল পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য। ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের ক্রীড়ামোদে এই সিনিয়র নেতার পক্ষে সক্রিয় জেলা-সদর উপজেলা ও পৌর কমিটির একাধিক নেতা, যারা নিখিলকে নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তার সমর্থকদের কৌশলী অবস্থান ইতোমধ্যেই ফাঁস হয়ে যাওয়ায়, সেই কৌশল কতটা কাজে আসবে বোঝা যাচ্ছে না। ফলে নিখিলের ভোট আর তার ভোট মিলেমিশে একাকার হলে তার পরিণতি নির্ভর করবে নিখিলের পরিণতির উপর। নিখিল জিতলে কামাল জিতবেন, হারলে কামাল হারবেন, আপাতত এটাই সমীকরণ। তবে ভিন্নরকম চিত্রও ঘটতে পারে, যদি কামাল চমকে দিতে পারেন !
হাজী কামাল উদ্দিন বলছেন, ‘আমার পুঁজি হচ্ছে সততা। এই সততার যারা সমর্থক তারা আমাকে নির্বাচিত করবেন। অনেক টাকাপয়সার ছড়াছড়ি হচ্ছে, তাতে কাজ হবে না।’ তারা আমার বিরুদ্ধে ‘আঞ্চলিক দলের সাথে লিয়াজোঁ’ আছে বলে যে অপপ্রচার করছে, সেটা যে সত্য নয় এটা তারাও জানে। ‘আমি কোন প্যানেলেই নাই’ অথচ প্রচার করা হচ্ছে আমি নিখিলের সাথে প্যানেল করেছি, এটা ঠিক নয়।’ ‘দাদার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা কেনো হয়েছে, আমি জানি না। তবে যে আমার বিপক্ষে প্রার্থী সে হয়ত এটা করেছে।’ ‘দীপংকর আর নিখিলের মধ্যে যে দূরত্ব’ সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি দুজনের সাথেই কথা বলেছি, তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য দিয়েছেন। উচ্চ আদালতে করা একটি রিট নিয়ে তাদের দূরত্ব আরো বেড়েছে। আমি চেষ্টা করেছি সেটা কমানোর, কিন্তু হয়নি। হয়ত তাদের মনের ভেতর ক্ষোভ রয়ে গেছে, তাই তারা নির্বাচন করছে। আমি কোন গ্রুপিংয়ে নাই। কিন্তু দীপংকর দাদা বিভিন্ন জায়গায় মুছার পক্ষে ভোট চেয়ে আমাকে দূরে ঠেলে দিলে আমার কি করার থাকে। সভাপতি বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নাই। কাউন্সিলররা যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকেই নির্বাচিত করুক।’
হাজী মুছা মাতব্বর বলছেন- ‘আমি ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে রাজনীতি শুরু করেছিলাম, সেখানেই স্থির থাকব আমৃত্যু। জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে পাহাড়ে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিতের উপর দাঁড় করাতে জীবনবাজি রেখে কাজ করেছি এবং করে যাচ্ছি। আমাদের নেতাকর্মীরা, কাউন্সিলররা অবশ্যই তার মূল্যায়ন করবেন, এ বিশ^াস আমার আছে।’ টাকা ছড়ানোর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মুছা বলেন- ‘যারা আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে, তারা অমানুষ। বরং যারা অভিযোগ করছে তারাই টাকা ছড়াচ্ছে।’ মুছা পাল্টা অভিযোগ করেন, তিনিই (কামাল) নিখিল কুমার চাকমার সাথে প্যানেল করেছেন, আমি তো কোন প্যানেল করিনি।’
অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলছেন, ‘আমাদের সম্মেলনের সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যেই উৎসবমুখর পরিবেশে সকল প্রার্থী যার যার প্রচারণায় ব্যস্ত। এটা খুবই ভালো একটা দিক, দলের গণতন্ত্রের চর্চা অবারিত হয়েছে। কাউন্সিলররাও স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন বলে আমার বিশ^াস। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমাদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।’ তবে নেতারা যাই বলুক না কেনো, আসন্ন সম্মেলন বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে রাঙামাটিতে। দীপংকর-নিখিল, মুছা-কামাল দ্বৈরথ জমিয়ে দিয়েছে রাজনীতি। পুরো জেলায় প্রাণচাঞ্চল্য আর জোর আলোচনা- পরিবর্তন নাকি ধারাবাহিকতা, সেটা নিয়েই। ২৪ মে সন্ধ্যায় সম্ভবত মিলবে সব প্রশ্নের উত্তর।